কেন আফগান নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে?

আফগানিস্তানে অহরহ আত্মহত্যা করেন নারীরা। প্রেমঘটিত অথবা অন্য কারণে এর ব্যাপকতা বেশি। এমনই একজন নারী জমিলা (তার প্রকৃত নাম নয়)। তিনি ভালোবাসতেন এক যুবককে। ৬ বছর ধরে তাদের মধ্যে সম্পর্ক। এনগেজমেন্টও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এতদিন পরে তার সেই প্রেমিক বা হবু বর তাকে সাফ জানিয়ে দেয়, তাকে আর বিয়ে করতে পারছে না সে। কারণ, ওই বর যতটা কম বয়সী যুবতীকে বিয়ে করতে চায়, জমিলা ততটা কম বয়সী নন। এমন ধাক্কা খেয়ে জমিলা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি গত মাসে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তবে তাকে উদ্ধার করে তার মা হেরাতের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার চিকিৎসা হয়। সুস্থ হয়ে ওঠেন জমিলা। তার বয়স এখন ১৮ বছর। যখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর তখনই তার পরিবার তার এনগেজমেন্টের ব্যবস্থা করে। প্রতি বছর এভাবে আফগানিস্তানে কয়েক হাজার নারী আত্মহত্যা করেন। তাদের মধ্যে একজন হতে যাচ্ছিলেন জমিলা। বিবিসি’র অনুসন্ধানে এমনই এক চিত্র ফুটে উঠেছে। আফগান ইন্ডিপেন্ডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এআইএইচআরসি) তথ্যমতে, প্রতি বছর আফগানিস্তানে এভাবে প্রায় ৩০০০ নারী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সারা দেশে যে পরিমাণ নারী আত্মহত্যা করেন বা করার চেষ্টা করেন তার অর্ধেকেরও বেশি হেরাত প্রদেশে। হেরাতের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তাদের মতে, শুধু ২০১৭ সালে ওই প্রদেশে ১৮০০ মানুষ আতহত্যার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে ১৪০০ হলেন নারী। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩৫ জন। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ। আগের বছর প্রায় ১০০০ আত্মহত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। সারাবিশ্বে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি আত্মহত্যা করেন। কিন্তু আফগানিস্তানে পুরুষদের তুলনায় নারীদের আত্মহত্যা প্রচেষ্টার হার শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বেশি। এআইএইচআরসি সতর্ক করেছে, আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কারণ, আফগানিস্তানে আত্মহত্যাকারীদের বিষয়ে অনেক মানুষই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নোটিশ করে না। এর পেছনে আছে নানা রকম কারণ। গ্রাম পর্যায়ে অনেক মানুষ ধর্মীয় কারণে আত্মহত্যা চেষ্টার কারণকে তাদের পরিবারের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করেন। দেশটিতে নারীদের আত্মহত্যা চেষ্টার হার বৃদ্ধি পাওয়ার একক কোনো কারণ দৃশ্যত নেই। এআইএইচআরসি-এর হাওয়া আলম নুরিস্তানি মনে করেন, এর কারণ হতে পারে মানসিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে বাড়িতে অশান্তি, জোরপূর্বক বিয়ে, সামাজিক নানা রকম চাপ। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাহলো আফগানিস্তানে জীবন, বিশেষ করে নারীদের জীবন অনেক বেশি জটিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, নানা রকম নিষ্পেষণমূলক অশান্তিতে ভোগেন আফগানিস্তানের ১০ লক্ষাধিক মানুষ। দেশটিতে ৪০ বছর ধরে রয়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেখানে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ব্যাপক বিস্তৃত। জাতিসংঘ জনসংখ্যা বিষয়ক তহবিলের হিসাবে, আফগানিস্তানের নারীদের মধ্যে শতকরা ৮৭ ভাগই শারীরিক, যৌন, মানসিক নির্যাতনের কমপক্ষে একটির শিকারে পরিণত হয়েছেন। আর শতকরা ৬২ ভাগ বহুবিধ নির্যাতনের শিকার। সেখানে অহরহ জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়। এ কারণে অনেক নারী নিজের জীবন রক্ষা করতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। নুরিস্তানি বলেন, নারীদের আত্মহত্যার অন্যতম একটি কারণ হলো নির্যাতন। এর বেশির ভাগই শুরু হয় পরিবারের ভেতরে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এর মধ্যে রয়েছে জোরপূর্বক বিয়ে। নারীদের কথা এক্ষেত্রে শোনা হয় না। তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া হয়। ইউনিসেফের একটি রিপোর্ট বলছে, ১৮তম জন্মদিনের আগেই আফগানিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া, ২০১৭ সালে প্রকাশিত এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, দরিদ্রতা ও কর্মসংস্থানের অভাব আফগানিস্তানের নারীদের পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও দেশটিতে নারীদের আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রাণনাশক বিষাক্ত দ্রব্যের সহজলভ্যতার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে। সেখানে খুব সহজেই কীটনাশক ও বিষাক্ত দ্রব্য পাওয়া যায়। হেরাত শহরের প্রধান হাসপাতালের মুখপাত্র মুহাম্মদ রাফিক সিরাজি বলেন, গত পাঁচ বছরে মানুষের জন্য ওষুধ ও অন্যান্য প্রাণনাশক দ্রব্য সংগ্রহ করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। এসব বিপজ্জনক দ্রব্যের সহজলভ্যতা রোধ করার জন্য গত বছরে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছি। দেশটির ডাক্তাররা বলছেন, কর্তৃপক্ষ যথাযথ কৌশল না নেয়া পর্যন্ত আফগানিস্তানে আত্মহত্যার হার কমবে না। কয়েকজন ডাক্তার জানিয়েছেন, নারীদের আত্মহত্যার কারণ ও উদ্দেশ্য উদঘাটনে জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। যেন মানসিক সমস্যার বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। কাবুলের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেন, নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধ করতে তারা জাতীয় পর্যায়ে একটি খসড়া পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছেন। এ পরিকল্পনার মধ্যে শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ‘থেরাপি সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও রয়েছে। আর জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা একটি কার্যকর পদক্ষেপের পরিকল্পনা করার জন্য ইতিমধ্যেই তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন। মানবাধিকার কর্মী নুরিস্তানি বলেন, আফগানিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের জন্য পরবর্তী কাজ হলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সচেতনতা অভিযান জোরদার করা। যেন মানুষ জানতে পারে যে, কোথায় ও কীভাবে তারা সাহায্য পেতে পারে। তিনি বলেন, মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা প্রয়োজন, যে নিগ্রহ নারীদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে সেগুলোর প্রতিকার আছে। এ ধরনের বেশিরভাগ নিগ্রহের ঘটনা সংঘটিত হয় একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে আইনকানুন সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা কম। মানুষ জানে না যে, নারীদের হয়রানি করলে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়। আফগানিস্তানে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি নিয়ে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় বা অন্ততপক্ষে আত্মহত্যার হার কমানোর জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.