ইতিহাস কি ছিল, কি দেখি আমরা… by তাজবীর তন্ময়

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্টার চার্চিল
নতুন প্রজন্ম জানে না পূর্বে কি ঘটেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন কিংবা ইতিহাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেমন ছিল তা নিজ চোখে দেখা সম্ভব ছিল না এ প্রজন্মের। ইতিহাসের উপর লেখা বই, প্রবীণদের মুখে শোনা ইতিহাস কিংবা সেলুলয়েড পর্দায় দেখা সিনেমাই তাদের একমাত্র সম্বল। ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বল্প সময়ে দ্রুত পৌঁছে দিতে সিনেমা কিংবা ফিল্মের চেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় আর নেই। আর এ জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, হিটলারের উন্মাদনা, মিত্র বাহিনীর সাহসিকতা, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের বীরত্বের উপর মুভি, সিরিজ, ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছে ভুরি ভুরি। এ প্রজন্ম সেগুলো দেখেই শিখছে ইতিহাসকে, নিজে শিখে আরেকজনকেও শিখাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, যা দেখছি এই ফিল্ম, সিরিজে তাই কি পুরো ইতিহাস? কিছু গোপন করা হচ্ছে না তো? দর্শকদের সামনে কি পুরো সত্যটাই তুলে ধরা হচ্ছে?
কয়েকদিন আগেই রিলিজ হল যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ডানকার্ক থেকে সাড়ে তিন লাখ ব্রিটিশ সৈন্যকে উদ্ধার কাজে চার্চিলের অসামান্য অবদান নিয়ে মুভি ‘দা ডার্কেস্ট আওয়ার’। উইনস্টন চার্চিল চরিত্রে অভিনয় করা গ্যারি ওল্ডম্যান জিতেও গেলেন সেরা অভিনেতার অ্যাকাডেমি পুরষ্কার। শুধু ‘দা ডার্কেস্ট আওয়ার’ নয়, চার্চিলের দূরদর্শিতা, সাহসিকতার ছোঁয়া পাওয়া যাবে ‘ডানকার্ক’, ‘চার্চিল’, ‘ইনটু দা স্ট্রোম’, ‘দা ফাইনেস্ট আওয়ার’ ইত্যাদি মুভি এবং ‘দা ক্রাউন’ সিরিজেও। এ শতকের সেরা ব্যাক্তিত্বদের একজন ধরা হয় চার্চিলকে। কিন্তু আমরা কি জানি যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৪৩ সালে ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ কিংবা ৪.৩ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর (তৎকালীন মোট জনসংখ্যার দশ ভাগের এক ভাগ) জন্য চার্চিল সরাসরি দায়ী? জেনেশুনেও তিনি ভারতীয়দের জন্য যে কোন সাহায্যের ব্যবস্থা করেন নি, এ জন্য যে তাঁকে অনেক ঐতিহাসিকগণ এ শতাব্দীর কুখ্যাত একনায়ক হিটলার, স্টালিন কিংবা মাও সে তুংয়ের সাথে দায়ী করে এই সত্যও থেকে যায় আমাদের অগোচরে।

চার্চিলকে ‘গণহত্যাকারী একনায়ক’ বলে আখ্যায়িত করেন এমনই একজন লেখক, ডক্টর শশী থারুর। তিনি তাঁর লেখা ‘ইনগ্লোরিয়াস এম্পায়ার’ বইতে তুলে ধরেছেন যুদ্ধকালীন সেরা নেতার বর্ণবাদী আদর্শের।
মেলবোর্ন লেখক সম্মেলনে তিনি বলেন, চার্চিল ভারতবর্ষে মজুতকৃত শস্য যুদ্ধরত সৈন্য এবং গ্রিকদের সাহায্যের জন্য মজুত রাখেন যখন ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষে চার মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি চার্চিলের বলা বিবৃতি সরাসরি তুলে ধরেন। চার্চিল বলেছিলেন,
  • *“আমি এই ব্লাডি ভারতীয়দের প্রচণ্ড ঘৃণা করি। দুর্ভিক্ষ হোক বা না হোক এরা ইঁদুরের ন্যায় বংশবিস্তার করতে থাকবে। ভারতবর্ষ বন্য ধর্মের অনুসারী একদল বন্য মানুষে পরিপূর্ণ”।
১৯৪২ সালের শেষদিকে ভয়াবহ সাইক্লোন হানা দেয় ভারতবর্ষে এবং সাইক্লোন পরবর্তী সময়ে ফাঙ্গাসের আক্রমণে কয়েক মণ শস্য নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও চার মিলিয়ন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব ছিল যদি অন্য কোথাও থেকে সাহায্য পাঠানো হতো। ২০১১ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক মাধুশ্রী মুখার্জী দাবী করেন, “চালকের আসনে থাকা প্রধানমন্ত্রী চার্চিল সাহেবই সাহায্য করার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। দুর্ভিক্ষ আসন্ন এমন পূর্বাভাস থাকার পরও চার্চিলের নির্দেশে ভারতবর্ষ থেকে ৭০,০০০ টন ধান (৪০০,০০০ মানুষের একবছরের খাবার) ব্রিটেনে মজুদ করা হয়, যেখানে ব্রিটেনের তৎকালীন জনসংখ্যা ছিল ভারতবর্ষ থেকে ১৫ মিলিয়ন কম। তিনি যে শুধু ভারতবর্ষের মজুত শস্য দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন এমন নয়; অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র ভারতবর্ষের জন্য ত্রাণ এবং খাবার সাহায্য পাঠাতে চাইলেও তিনি বাধা দেন। কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান জাহাজ ত্রাণ নিয়ে ভারতবর্ষ ঘেঁষে ইউরোপে প্রবেশ করলেও চার্চিল ভারতে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। এমনকি নাৎসী মিত্র জাপান বার্মা দখল করে নিলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক বিরাট বহর ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত হয়। তারা ১৮০,০০০ কৃষককে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের ১৭৫,০০০ একর আবাদি জমি মিলিটারি ক্যাম্পের জন্য দখল করে। এমনকি বাংলার খাদ্যশস্য সর্বদা জলযানে করে আনা নেওয়া করা হয় জানা সত্ত্বেও সকল নৌযান মিলিটারির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। উপরন্তু, এসময় চার্চিল ভারতবর্ষের উপর “স্কর্চড আর্থ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সকল শস্যক্ষেত পুড়িয়ে দেন যাতে করে জাপান আর্মি আক্রমণ করেও বেশি কিছু অর্জন করতে না পারে”।

দুর্ভিক্ষ ছিল ভয়াবহ। মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় ঘাস, লতাপাতা খাওয়া শুরু করেছিলো। মৃতপ্রায়রা আগে থেকেই কবরস্থান কিংবা নদীর পাড়ে চলে যেতো কারণ মৃত লাশ বহন করার মতো শক্তিসামর্থ্য জীবিতদের ছিল না। মা-বাবা মৃতপ্রায় সন্তানদের নদীতে কিংবা পুকুরের পানিতে ফেলে দিত মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রক্ষা দিতে। মরা লাশের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে ছিল, খাওয়ার মতো পানি ছিল না। এ দুর্ভিক্ষে তারাই কোনমতে বেঁচে ছিল যারা কলকাতায় কোনমতে চাকরি জোগাড় করতে পেরেছিল কিংবা বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলো।
ব্রিটেনের মানুষজন যাতে দুর্ভিক্ষের সংবাদ না পায় তা নিয়ে কড়াকড়ি নির্দেশ ছিল চার্চিল সরকারের। এমনকি দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা, চিত্রকর্ম এবং একটি বই সরাসরি ব্যান করা হয়েছিলো। স্যার আর্চিবাল্ড ওয়াভেল এবং তৎকালীন সেক্রেটারি অফ ষ্টেট অফ ইন্ডিয়া, লিওপড এ্যমিরী বারংবার সাহায্যের জন্য নিবেদন করলেও চার্চিল আগ্রহ দেখাননি। তিনি ভারতবাসীদের সাহায্য করার চেয়ে গ্রীসে ত্রাণ পাঠাতে অধিক আগ্রহী ছিলেন। এমনকি তিনি এও বলেন,
  • *“এতো দুর্ভিক্ষ হলে অর্ধনগ্ন সাধু বাবা গান্ধী মরে না কেন?”
২.৫ মিলিয়নের অধিক ভারতীয় সেনা যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পক্ষে শরিক হয়েছিলেন। ভারতবর্ষের সেনাবাহিনী কিংবা সম্পদ উভয়ই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এই সত্য অস্বীকার করেনি কোন ঐতিহাসিকই। কিন্তু তারপরও ভারতবর্ষের প্রতি এতো অনীহা ছিল কেন চার্চিলের?
সুদূর ইউরোপে হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাওয়া লেগেছিলো এই বাংলা পর্যন্ত! আর পাশের দুই প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে সে আগুনের আঁচ কি আমাদের গায়ে লাগবে না? এরপরেও কি আসন্ন যুদ্ধের কথা ভেবে আপনার মনে পুলক জাগছে?

মাধুশ্রী মুখার্জীর মতে, ৪০’র দশকের শুরুতেই ব্রিটিশরা বুঝতে পারে তাদের পক্ষে আর বেশীদিন ভারতবর্ষ শাসন করা সম্ভব নয়। সাম্রাজ্যের অধীনে থাকবে না এমন রাজ্যকে সাহায্য করতে চার্চিলের ইচ্ছা ছিল না। এমনকি চার্চিল প্রচণ্ড বর্ণবাদী ছিলেন, উপমহাদেশের মানুষকে দেখতে পারতেন না এমন তথ্য উঠে এসেছে তাঁর নিকট বন্ধু, আত্মীয়বর্গের কাছ থেকেই।
চার্চিলের পরিবার এবং সমর্থকরা দাবী করেন, চার্চিল দায়ী ছিলেন না এই গণমৃত্যুর জন্য। ইউরোপের ভালোর জন্য তিনি যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মূলত ভারত সরকারই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। অনেক ঐতিহাসিকের দাবী, সময়ের তাগিদে, যুদ্ধের প্রয়োজনেই অনেক নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
কিন্তু সত্যিই কি এই দুর্ভিক্ষপীড়িত ৪ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু প্রয়োজন ছিল নাকি শাসকদের অবহেলায় এ গণমৃত্যুর ঘটনা ঘটলো এইটাই বিচারের বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.