মানব কঙ্কাল বাণিজ্যে শতাধিক চক্র by শুভ্র দেব

সারা দেশে মানব কঙ্কাল নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। কবরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরি করে বিক্রি হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের কাছে। এসব কঙ্কাল  বিক্রি করা হয় চড়া দামে। কঙ্কাল বিক্রি করে অনেকেই রাতারাতি কামিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অভিযোগ আছে বিদেশেও পাচার করা হয় কঙ্কাল। সরকারি মেডিকেলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর যোগসাজশে এই কাজে শতাধিক চক্র জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মূলত প্রত্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন কবর থেকে গভীর রাতে দুর্বৃত্তরা কঙ্কাল চুরি করে। পরে প্রক্রিয়াকরণ করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জেলা শহরের ও ঢাকার বিভিন্ন মেডিকেল পাঠানো হয়। প্রতিটা কঙ্কাল অন্তত ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। শুধু কঙ্কাল নয়, মানুষের মরদেহ পর্যন্ত চুরি করে বিক্রি করে এই চক্র।
চলতি বছরের মার্চ মাসে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভাঙ্গনামারী ইউনিয়নের কুলিয়ারচর ও গজারিয়া গ্রাম থেকে ২৭টি কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটে। ২রা মে গভীর রাতে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার জৈনসার ইউনিয়নের চম্পকদি কবর স্থান থেকে ১০টি কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটেছে। চম্পকদির বাসিন্দা ইমরান হোসেন পরের দিন ওই কবর স্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি কয়েকটি কবর খোঁড়া দেখতে পান। পরে গ্রামবাসীকে বিষয়টি জানালে কঙ্কাল চুরির ঘটনা নিশ্চিত হয়। ৭ই জানুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী ইউনিয়নের বানিয়ারার একটি কবরস্থান থেকে ৯টি কবর খোঁড়ে ৫টি কঙ্কাল চুরি হয়েছে। গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর শ্রীপুরের ধনুয়া গ্রামের ইন্নছ আলী নজর আলীর পারিবারিক কবরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটে। এর আগে ২১শে নভেম্বর একই ইউনিয়নের নিজ মাওনা গ্রাম থেকে এক ব্যক্তির মরদেহ চুরি হয়েছিল। কঙ্কাল চুরি হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও কারা চুরি করে বা কঙ্কাল চুরির দায়ে ধরা পড়েছে এ ধরনের খবর  খুব বেশি না। দুর্বৃত্তরা অনেকটা গোপনেই রমরমা এই ব্যবসা করে যাচ্ছে। গত বছরের ৮ই নভেম্বর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দুই কঙ্কাল চোর। তাদের কাছ থেকে জানা যায় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গাজীপুরের টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকাতে বাসে তল্লাশি চালিয়ে দুই যুবককে আটক করেছিল পুলিশ। তারা হলেন- শেরপুরের নকলা এলাকার ওমর আলীর ছেলে এরশাদ (২৬) ও গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তাইজুল ইসলামের ছেলে মোতা্বে (২২)। এরশাদ গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে দু’টি কঙ্কাল চুরি করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বিক্রির জন্য যাচ্ছিলেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এরশাদ জানায়, তারা চুরি করে আনা প্রতিটি কঙ্কাল ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। কিন্তু যাদের কাছে বিক্রি করে তারা আরো বেশি দামে বিক্রি করে। মেডিকেল কলেজগুলোতে কঙ্কালের অনেক চাহিদা রয়েছে। সিন্ডিকেটরা বিদেশেও কঙ্কাল পাচার করছে বলে তারা জানায়। তারা গ্রামেগঞ্জের কবর থেকে কঙ্কাল চুরি করে। নির্দিষ্ট একটি দামে তুলে দেয় মেডিকেল কলেজের দালালদের কাছে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে রাজধানীর কাফরুলের ইটখোলা এলাকার একটি বাসা থেকে ৪০টি মানব কঙ্কাল উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ওই সময় বাসা থেকে নুরুজ্জামান নামের এক মেডিকেল শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। সে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নুরুজ্জামান জানিয়েছিল, সিনিয়র ভাইদের  কাছ থেকে কঙ্কাল কিনে সে জুনিয়র শিক্ষার্থীর কাছে বিক্রি করে।
স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মিডফোর্ডের এমবিবিএস শেষ বর্ষের ফল প্রত্যাশী শিক্ষার্থী মাঈনুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, আমরা মূলত দুইভাবে কঙ্কাল পেয়ে থাকি। প্রথমত সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে তাদের পুরাতন কঙ্কাল ক্রয় করি। আর তা না হলে সিনিয়র ভাইয়েরা নতুন কঙ্কাল কিনে দেন। তবে তারা কিভাবে এটা সংগ্রহ করেন তা আমরা জানি না। পুরাতন কঙ্কাল আমরা সাধারণত ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কিনি। আর নতুন কিনলে তার চেয়ে বেশি খরচ হয়। তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি কঙ্কাল সাধারণত ভারত থেকে আনা হয়। কিন্তু ভারত থেকে আনা কঙ্কালের খরচ অনেক বেশি পড়ে। তাই দেশের কঙ্কাল দিয়েই সাধারণত মেডিকেল শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটানো হয়। শুনেছি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আনা কঙ্কাল রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের পদ্মার পাড়ে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কবর থেকে কঙ্কাল চুরির পাশাপাশি সরকারি মেডিকেল কলেজের অসাধু কর্মচারীরা কঙ্কাল সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে মেডিকেলের মর্গে আসা বেওয়ারিশ মরদেহকে কাজে লাগানো হয়। বেওয়ারিশ মরদেহের যদি কিছুদিন ওয়ারিশ খুঁজে পাওয়া না যায় তবে একজন নকল ওয়ারিশ তৈরি করা হয়। ওই ওয়ারিশকে দিয়েই লিখিতভাবে মরদেহটি দান করানো হয়। পরে মরদেহটি দুই থেকে তিন লাখ টাকা দামে বিক্রি করা হয়। মেডিকেল শিক্ষার্থীরা কিছুদিন তাদের শিক্ষণ প্রশিক্ষণে ব্যবহার করার পর কঙ্কাল তৈরি করা হয়। বিক্রি করা হয় মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কাছে। অনেক সময় সরকারি মেডিকেলের শিক্ষার্থী ছাড়া বেসরকারি মেডিকেলে বিক্রি করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি মেডিকেল কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী মানবজমিনকে বলেন, এমবিবিএস-এর প্রথম দেড় বছর এনাটমি বিভাগে কঙ্কালের প্রয়োজন হয়। তখন প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কঙ্কাল সংগ্রহের হিড়িক পড়ে। সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে ছাড়া যে যার মতো কঙ্কালের ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে গুনতে হয় বড় অংকের টাকা। বাজারে প্লাস্টিকের কঙ্কাল পাওয়া গেলেও সেটা দিয়ে ভালো শেখা যায় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এনাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লায়লা আনজুমান বানু মানবজমিনকে বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের জন্য স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই কোনো ব্যক্তির দানকৃত মরদেহ ও বেওয়ারিশ মরদেহ থেকে কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়। একসময় চিকিৎসকরাই মরদেহ থেকে কঙ্কাল প্রক্রিয়া করত। কিন্তু এখন মেডিকেল কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা এই কাজ করছে।
বিএসএমএমইউ’র এই চিকিৎসক মনে করেন বাংলাদেশে কঙ্কাল বহন, বিক্রি বা এর কোনো মূল্য নেয়া হবে কিনা, যদি নেয়া হয় কত নেয়া হবে এর কোনো নীতিমালা নেই। তাই কঙ্কাল নিয়ে অনেক বাণিজ্য হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ নিয়ে অনেক বলা হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি ভীষণভাবে চাইছি একটা নীতিমালা হোক। তা না হলে অনেকেই মরদেহ ও কঙ্কাল নিয়ে ব্যবসা করবে। কারণ অন্য কোনো দেশ থেকে আমাদের কঙ্কাল আমদানি করার প্রয়োজন হয় না। বরং আমাদের দেশ থেকেই হয়তো কোনো না কোনো ভাবে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.