‘ইয়াবা পিতাগণ’ এবং ‘দখল’! by আহসান কবির

এক লোক বারে বসে আরাম করে মদ খাচ্ছিল। বার থেকে বেরিয়েই তার চোখ ছানাবড়া। পুলিশ! সে দৌড় শুরু করলো। পুলিশও পিছু নিলো। উপায়ান্তর না দেখে পাঁচিল ডিঙিয়ে মাতাল লোকটা ঢুকলো একটা কবরস্থানে। একটা কবরের পাশে বসে সে কান্না শুরু করলো। পুলিশ কবরস্থানের পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে টর্চলাইটের আলো ফেলে জানতে চাইলো- জনাব কী করেন এখানে? লোকটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, স্যার বাবার কবর জেয়ারত করি। পুলিশ কবরের গায়ে টর্চের আলো ফেলে বললো, খেয়াল করে দেখুন এটি একটি সাত বছরের ছেলের কবর। মদখোর লোকটি বললো, ঠিকই বলেছেন স্যার। আমার বাবা খুবই অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন!
সারাদেশে যখনই মাদকবিরোধী অভিযান চলে, যারা নাকি মাদকের সঙ্গে খুবই অল্প জড়িত, যারা নাকি পেটের দায়ে মাদকের ‘ক্যারিয়ার’ হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়, এ পর্যন্ত নাকি তাদেরই বেশি বেশি ধরা হয়েছে। যারা মাদক চোরাচালানি বা ব্যবসার সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় জড়িত, যারা তৈরি করে, যারা সরবরাহ করে, শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই তারা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারা ‘ক্যারিয়ার’, যার ‘দখল’ থেকে পুলিশ মাদক উদ্ধার করে তারাই নাকি শুধু শাস্তি পায়। এই ‘ক্যারিয়ার’রাই আছে পুলিশের কাছে, আশপাশে। বড়দের পাত্তা নাই।
সক্রেটিসের একটা মূল্যবান কথা এমন– যাদের টাকা আছে (টাকাই ক্ষমতা) আইন তাদের কাছে আকাশের মতো। আর যাদের টাকা নেই আইন তাদের কাছে মাকড়সার মতো। যারা মাদকের সঙ্গে অল্পবিস্তর জড়িত আইনটা তাদের কাছে মাকড়সার মতো বলে তারা ধরা পড়েন, হয়তো শাস্তি পান। আর যারা ‘পিতৃদেব বা গডফাদার’  তারা (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, তারা থাকেন  ঈশ্বরের মতো ভদ্রপল্লীতে) থাকেন সবসময়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্তত একজন পিতৃদেব (কেউ কেউ তার নাম দিয়েছেন ‘ইয়াবা পিতা’) আর দুইজন প্রভাবশালী মানুষ যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত আছেন বলে পত্রিকা ও গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, তারা এখনও নাগালের বাইরেই আছেন। এই তিনজনের একজন বদি, একজন সাইফুল এবং অন্যজন আশরাফ। তবে মাদকের সঙ্গে জড়িত অনেকে ২০১৮ সালের মে মাসের মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন, ক্রসফায়ারে মারা গেছেন একশ’র বেশি মানুষ। খবরে বেরিয়েছে, পুলিশি এই অভিযানের ভেতরই নাকি যশোরের তিন মাদক ব্যবসায়ী নিজেরা নিজেরা মারামারি করে মরেছে। এটা সত্যি নাকি ‘ক্রসফায়ার বাস্তবতার’ গল্প সেটা বিধাতাই ভালো জানেন।
বিধাতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা কিংবা স্বর্গীয় আনন্দ পেতে বিখ্যাত গায়ক কেএল সায়গল প্রায়ই মদ পান করতেন। মদপানের একপর্যায়ে তার ‘ফিলিংস’ চরমে পৌঁছাতো। তখন তিনি গানে কণ্ঠ দিতেন। সায়গলকে নিয়ে প্রচলিত গল্পটা এমন- তিনি একটি মাত্র গান দুইবার কণ্ঠ দিতে রাজি হয়েছিলেন। একবার মদপানের আগে এবং একবার মদপানের পরে। গানটি ছিল ‘যব দিল হায় টুট গায়া’। মদপানের আগের গায়কীটাই নাকি সুন্দর ছিল। যাহোক সায়গলও খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। মাদক নিয়ে সবচেয়ে মূল্যবান কথাটা বোধকরি এই- ‘চাইনিজ মাল হোক আর জাপানিজ মাল হোক, দেশি খান আর বিদেশি খান, যারা মাল খায় তারা বেশি দিন টেকে না।’ (এদেশে নেশা সংক্রান্ত একটা দেয়াল লিখন চোখে পড়ে- নেশা খাবি খা, মারা যাবি যা!)
বিখ্যাতদের (এরা আবার মাদকের গডফাদারও না,অল্প বিস্তর ক্যারিয়ারও না। এরা দুনিয়াকে বদলে দেওয়া মানুষজন!) নেশা ভাং করা নিয়ে অনেক গালগপ্প প্রচলিত আছে। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ তানসেন নাকি গাঁজা না খেলে গানের সৃষ্টিতে মেতে উঠতে পারতেন না! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জেলেদের জীবন দেখতে রাতের পর রাত নাকি মাঝনদীতে জেলে নৌকায় কাটাতেন। সঙ্গী ছিল পানীয়! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক লেখাতে উল্লেখ ছিল– ‘আমরা যখন কফিহাউজে টুকটাক আড্ডা মারতে শিখেছি তখন একদিন জানলাম প্রথাবিরোধী খ্যাত কমল মজুমদার খালাসিটোলায় আড্ডা মারেন। সেখানে তিনি বাংলা মদ খেতেন কিন্তু কখনো তাঁকে বসতে দেখিনি। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারতেন’! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং নির্মলেন্দু গুণের লেখায় কবি অ্যালেন গ্রিন্সবার্গ (১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শরণার্থী যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের দেখতে এসেছিলেন গ্রিন্সবার্গ। এ নিয়ে তার বিখ্যাত কবিতার শিরোনাম ছিল-সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড) এবং বিট কবিদের জীবনযাপন নিয়ে অনেক মজাদার তথ্য আছে। বিট কবিদের নেশা করাটাও নাকি ছিল দেখার মতো। কবি ডিলান থমাস হার্ডসন স্ট্রিটের হোয়াইট হর্স ট্যাভার্নে বসে আড্ডা মারতেন। তার কাছে আড্ডা ও পান করা সমর্থক ছিল। মৃত্যুর আগের দিন গর্ব করে বলেছিলেন, চলে যাবো বলে এক বসায় ১৮ পেগ পর্যন্ত খেয়েছি। কবি  ও’ হেনরি যেখানে আড্ডা দিতেন ও পান করতেন সেটা একসময়ে ফুলের দোকানে রূপান্তরিত হয়েছিল। ও’হেনরি তখন থেকে নাকি ফুল আর মদকে একসঙ্গে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। আর্নেস্ট হোমিংওয়ে অনেকদিন ধরেই প্যারিসের রিজ হোটেলে আড্ডা মারতেন আর মদ গিলতেন। প্যারিসের হ্যারিস নিউইয়র্ক বারেও আড্ডা দিতেন হোমিংওয়ে। হামফ্রে বোগার্টসহ আরও অনেকে আসতেন সেখানে। কালের পরিক্রমায় রিজ হোটেলের বারের নাম এখন আর্নেস্ট হোমিংওয়ে বার। ফ্রান্সে যারা ঘুরতে যান তারা অনেকেই হোমিংওয়ে বারে যেতে ভুল করেন না। স্বাধীনতার পর ঢাকার হাইকোর্টের মাজারে নতুন এক আড্ডা জমে উঠেছিল। অনেকেই যেতেন সেখানে। গাঁজা টানাটা শিল্পে পরিণত করেছিলেন নাকি নুরা পাগলার আসরে যারা যেতেন তারা। শোনা যায় নুরা পাগলার অনেক সমঝদার ভক্ত ছিল।
রাজারা যেমন অনেকগুলো বিয়ে করার পরেও হেরেম পছন্দ করে, তেমনি বিখ্যাতদের নাকি এমন আসক্তি থাকেই। রবীন্দ্রনাথের নেশা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও দেশ বিদেশের যেখানেই যেতেন অনেক কলম কিনতেন। সেসব কলম দিয়ে একটুও লিখতেন না। আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি টাকা পেলেই পাখি কিনতেন। এরপর আয়োজন করে সেসব পাখি আকাশে উড়িয়ে দিতেন। ইদানীংকালে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে যাদের ক্রসফায়ারে নেওয়া হচ্ছে তারা কি আকাশের দিকেই চলে যাচ্ছে সবাই?
প্রায় সব পত্রিকা, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ইয়াবা পিতা’ বলা হচ্ছে সরকারদলীয় এমপি বদিকে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে বদির ব্যাপারে তাদের কাছে কোনও প্রমাণ নেই! তবে ইয়াবার ব্যাপারে আরও দুজনের নামও শোনা যায়। একজন হচ্ছেন বদি সাহেবের ভাই ওয়ার্ড কাউন্সিলর মৌলভী মজিবর। আর একজন হচ্ছেন হাজী সাইফুল করিম। তিনি এসকে ট্রেডার্সের মালিক, তবে ইয়াবা ব্যবসার টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছেন ট্রলার, জাহাজ ব্যবসা ও গার্মেন্ট শিল্প। কক্সবাজারের কলাতলীতে হোটেল বানাচ্ছেন। পত্রিকার খবরে জানা যায়, থানার এক ওসি নাকি হাজী সাহেবের হোটেল নির্মাণের তদারকি করেন। একদা বিএনপির রাজনীতি করলেও হাজী সাইফুল করিমের সঙ্গে বদির সম্পর্ক খুবই ভালো। তবে দু’জনার ইয়াবা সরবরাহের রুট নাকি ভিন্ন। এই দু’জন ইয়াবা পিতাও আছেন বহাল তবিয়তে। আরেকজন ট্রলার চালক, যার নাম আশরাফ, তিনিও ইয়াবা ব্যবসায় নাম করেছেন। প্লেনে করেই মিয়ানমার যান তবে ইয়াবার চালান নিয়ে ফেরেন ট্রলারে বা জাহাজে। সৌদি আরবেও গিয়েছিলেন, গাড়ি বাড়ি সবই করেছেন। ইয়াবালোক (ভদ্রলোকের মতো যে ইয়াবা সরবরাহের সঙ্গে জড়িত সে ইয়াবালোক!) আশরাফের আসল বাড়ি মিয়ানমারের মংডুতে। উনি হয়তো আদি-অকৃত্রিম রোহিঙ্গা ইয়াবালোক। তবে ইকরাম নামে বদি সাহেবের এলাকার এক যুবলীগ নেতা ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর কয়েকটি পত্রিকা ও ফেসবুকে খবর এসেছে যে ইকরাম নাকি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। হায়, একজন নিষ্পাপ মানুষও যদি মারা যায় তার দায়ভার কে নেবে?
মাদক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত থাকেন তাদের ওপরে আইনের প্রয়োগটাও বড় বিচিত্র। যারা মাদক তৈরি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান, যার দখলে মাদক তিনিই ধরা খান। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তামান্না নামের এক কিশোরী ৫০০ পুরিয়া হিরোইসহ ধরা পড়েছিল। সে গ্রেফতার হয়েছে কিন্তু ওই কিশোরীকে যারা হেরোইন সরবরাহ করেছিল তারা কেউ ধরা পড়েনি। মাদকের নিয়মিত বিক্রেতা মিনারার বিরুদ্ধে ১৭টি মাদকের মামলা রয়েছে। সে জেলে আসে আবার যায়। একই অবস্থা রুশিয়া বেগম ওরফে মাফিয়া চুন্নীর। ছোটখাটোদের বাদ দিলে ১৯৯৯ সালে ২৫ কেজি হেরোইনসহ ধরা পড়েছিল পাকিস্তানি নাগরিক ইব্রাহিম, রইস ও আলেফজান। ইব্রাহিম মারা গেলেও বাকি দুজনের মৃত্যুদণ্ড হয়। এদের বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানকারী। তারা যাদের জন্য হেরোইন এনেছিল তারা হচ্ছে এদেশের এরশাদ, হানিফ, দুলাল ও জাহাঙ্গীর। এই চারজন কিন্তু একই মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছিল। ২০১৪ সালের এপ্রিলে নাইজেরিয়ার নাগরিক অ্যালেফেয়ান জ্যাকভ ধরা পড়েছিল হেরোইনসহ। সেও বেকসুর খালাস পায়। হিরোইন হোটেল রুমে পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু তার দখলে ছিল কিনা তা নাকি আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। জ্যাকভের মতো আরও সাত নাইজেরিযান ধরা পড়েছিল হেরোইনসহ। তারাও খালাস পেয়েছে ‘দখল’ প্রমাণ করা যায়নি বলে।
বদি সাহেবের ব্যাপারেও বোধকরি দখল প্রমাণ করা যাবে না। এছাড়াও উনি চা সিগারেট খান না, এমনকি আড্ডাও মারেন না। মাদকের সংজ্ঞাও বোধকরি বদলে ফেলতে হবে। গাঁজা আফিম ভাং মদসহ অনেক কিছুই আছে মাদকের তালিকায়, ইয়াবাটা আসলে কোন তালিকা বা নামে আছে সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
হত্যাযজ্ঞের পর হিটলার নাকি ভায়োলিন বাজাতেন। গবেষণাকর্মে অগ্রগতি হলে নাকি পিয়ানো বাজাতেন আইনস্টাইন। মাদক ধরা পড়ার পর পুলিশ অবশ্য বিভিন্ন রঙের কাগজে সেটা উল্লেখ করতে পারেন। যেমন আলেকজান্ডার ডুমা নীল রঙের কাগজে উপন্যাস লিখতেন। গোলাপি কাগজে লিখতেন কবিতা আর পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন হলুদ কাগজে।
একসময়ে চীনারা আফিম খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকতো। রাশানরা বুঁদ হয়ে থাকতো ভদকায়। বাংলাদেশের ছেলেপেলেরা এখন ইয়াবা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে।
জানি না কীভাবে আসক্তি থেকে ফিরবে তারা।
আহসান কবির
লেখক: রম্যলেখক

No comments

Powered by Blogger.