যেভাবে রক্ষা পেলো মেয়েটি by সিরাজুস সালেকিন

দুই তরুণীর বুদ্ধিমত্তায় প্রতারক প্রেমিকের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে চুয়াডাঙ্গার এক স্কুলছাত্রী। প্রেমের টানে ও বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ওই কিশোরী ঢাকায় এসেছিল। পথে সহযাত্রী দুই তরুণীর সাহসী পদক্ষেপের কারণে অপহরণের কবল থেকে রক্ষা পায় মেয়েটি। প্রতারক প্রেমিক শহীদুল ইসলাম বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেছে ওই কিশোরী। ওই কিশোরীকে অপহরণের হাত থেকে রক্ষা করা দুই তরুণীর একজন চুয়াডাঙ্গা সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী নাজমা আক্তার (ছদ্মনাম)।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় চুয়াডাঙ্গা বড়বাজার কাউন্টার থেকে রয়্যাল এক্সপ্রেস বাসে করে ঢাকা আসছিলেন তিনি ও তার বান্ধবী সায়মা (ছদ্মনাম)। পথে ডাকবাংলা থেকে একজন বোরখা পরা মেয়ে বাসে ওঠে তাদের বিপরীত পাশে সিটে বসে। মেয়েটির সঙ্গে আলাপচারিতার পর তারা জানতে পারে, মেয়েটি দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে স্থানীয় এক কলেজে। গরিব কৃষকের তিন মেয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। তার বাবা তাকে গাড়িতে তুলে দিতেও এসেছিলেন। মেয়েটি জানায়, বিয়ে করতে সে ঢাকায় যাচ্ছে। দুই মাস আগে মোবাইল ফোনে দুঃসম্পর্কের এক ভাবির মাধ্যমে এক লোকের সঙ্গে তার প্রেম হয়। যার জন্য সে বাবার ঘর ছেড়ে কথিত প্রেমিকের ঘরে যেতে বের হয়েছে। বিষয়টি তার পরিবারের সবাই জানে। ফলে তার বাবা তাকে তার কথিত প্রেমিকের উপর ভরসা করে ঢাকায় একা একা পাঠিয়ে দেন। মেয়েটি জানায়, লোকটির নাম শহীদুল ইসলাম। দেশের স্বনামধন্য একটি টিভি চ্যানেলের একজন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার। এ ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে যান নাজমা ও সায়মা। তাদের মনে সন্দেহ হয়। মোবাইল ফোনে পরিচয় গত দুই মাস ধরে। প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে এসে তার পরিবারকেও এক প্রকার গ্রাস করে ফেলেছে। এতটাই গ্রাস করেছে যে, মেয়েটির বাবা এই কথিত সাংবাদিক এর উপর ভরসা ও বিশ্বাস করে মেয়েটিকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। এমনকি লোকটির কোনো ছবিও মেয়ে বা তার পরিবারের কেউ দেখেনি। তারা আরও জানতে পারে, মেয়েটি এই প্রথমবার ঢাকা শহরে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ফোনেই তাদের আলাপ হচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই তাদের দুই বান্ধবীর কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। এই মেয়ে নির্ঘাত কোনো প্রতারণার শিকার হচ্ছে বলে তাদের আশঙ্কা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা দু’জন সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই মেয়েকে যে ভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। তারা কথার ছলে সবকিছু জানার চেষ্টা করে। ততক্ষণে বাস ফেরি পার হয়ে সাভারের কাছে পৌঁছে। মেয়েটির সঙ্গে কথার ছলে তারা জানতে পারে, সাংবাদিক পরিচয় দেয়া মেয়েটির কথিত প্রেমিক শহীদুল তাকে রিসিভ করার জন্য গাবতলী মাজার রোডে আসবে। নাজমা ও সায়মা সিদ্ধান্ত নেয় তারা নিজেদের গন্তব্য টেকনিক্যাল মোড়ে না নেমে গাবতলী মাজার রোডে নামবে। ইতিমধ্যে তারা ঐ সাংবাদিকের নামে অনলাইনে সার্চ করে তার ফেসবুক আইডি পায়। তার ছবি এবং কর্মকাণ্ডের ছবি দেখে বুঝে ফেলে এই সাংবাদিক এর ইনফো সব ঠিকই আছে। কিন্তু মেয়েটি যেভাবে বর্ণনা করছে তার সঙ্গে ওই প্রতারকের তথ্য মিলছে না। তারা পরিচিত এক সাংবাদিককে ফোন দিয়ে ঘটনাটি জানায়। তাদের কিছু ছেলে বন্ধুকে ডেকেও আনে গাবতলীতে। বাস থেকে নেমে মেয়েটিকে বলা হয় তার প্রেমিককে ডেকে আনতে। মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে পেছনে দুই বান্ধবী ও তাদের বন্ধুরা লুকিয়ে থাকে। এরপর ওই প্রতারক সামনে এলে সবার চোখ ছানাবড়া। লোকটি পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের। এবং দুপুরের তীব্র গরমের মধ্যেও লাল একটি সোয়েটার গায়ে। মুখে মাস্ক এবং কানে হেডফোন। যা ইন্টারনেটে সার্চ করা সাংবাদিকের সাথে কোনভাবেই মিলে না। সবাই লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর লোকটিকে পাশের এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় তারা। তার প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ডসহ বিভিন্ন রকম প্রমাণ চাওয়া হয়। কিন্তু লোকটি নিজেকে সাংবাদিক প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে নাজমা ও তার বন্ধুরা নিশ্চিত হয়ে যায় মেয়েটি খুব বড় রকমের একটা প্রতারণায় পড়েছে। পরে এক সাংবাদিকের সহযোগিতায় স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করে লোকটিকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। রাতে ভিকটিম নিজেই শহীদুলের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দায়ের করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আসামি শহীদুল জানিয়েছে, তার বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায় এবং তার একাধিক স্ত্রীসহ বাচ্চা রয়েছে। সে মেয়েটির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে এই কাজ করেছে এবং তাদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ আরও জানায়, মেয়েটি স্কুলছাত্রী এবং সে প্রথমে নিজেকে কলেজছাত্রী পরিচয় দিয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দারুস সালাম থানার এসআই রবিন মণ্ডল জানান, ধারণা করা হচ্ছে শহীদুল একজন পেশাদার প্রতারক। তাদের একটি চক্র থাকতে পারে। প্রেমের ফাঁদে ফেলে মেয়েদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতো তারা। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পুলিশ মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মেয়েটিকে প্রতারকের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরে উচ্ছ্বসিত নাজমা বলেন, এত কষ্টের মাঝেও কেন জানি অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে। বর্ণনা করার ভাষা নেই। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছিল আসার সময় মেয়েটি যখন আমাদের দুইজনের হাত দু’টি শক্ত করে চেপে ধরেছিল। নিজের অজান্তেই চোখ ছলছল করে উঠেছিল। নাজমা বলেন, বন্ধুরা একসাথে থাকলে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারার আত্মবিশ্বাস আমাদের জন্মে গেছে। জানি না যদি বাসে মেয়েটি আমাদের পাশের সিটে না বসতো তবে হয়তো আগামীকালের কোনো এক দুঃসংবাদের শিরোনাম হয়ে যেত সে।

No comments

Powered by Blogger.