সুচি’র বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা by মাহমুদ ফেরদৌস

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশটির মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নিধন করার অভিযোগ উঠেছে অনেকদিন হলো। কিন্তু বেশ কয়েক সপ্তাহ নিরবতা বজায় রাখার পর, দেশটির নেত্রী অং সান সুচি অবশেষে এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন। কিন্তু জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার ভাষণের পর, এই সংকট নিরসনে বিশ্ব আশাবাদী হওয়ার বদলে যেন আরও ক্ষুদ্ধ হয়েছে। বিতর্কিত এই বক্তব্যের পর তার সমালোচনা আরও বেড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই বক্তব্যে তিনি অনেক কিছু বলেছেন, যেগুলো ‘নির্জলা মিথ্যা’ কিংবা ‘বিভ্রান্তিকর’। এরই প্রেক্ষাপটে বৃটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান সুচি’র বক্তব্যের কিছু আলোচিত অংশ যাচাই-বাছাই করে তুলে ধরেছে সেগুলোর সত্যতা কতটুকু। 
সুচির বক্তব্য: আমি মনে করি, আমার উচিত আপনাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে আমাদের সরকার ক্ষমতায় এসেছে এখনও এমনকি ১৮ মাসও হয়নি।
গার্ডিয়ান: সত্য। ২০১৫ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিরাট বিজয় অর্জন করেন সুচি। অবসান ঘটে কয়েক দশক ব্যাপী দীর্ঘ সামরিক শাসনের। তবে সেনাবাহিনী এখনও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছে: প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত। ফলে এই সংকটে বেসামরিক সরকার ছিল অনেক দুর্বল ও অনেকের মতে স্বল্প-কার্যকরী।
সুচি’র বক্তব্য: কয়েক মাস ধরে শান্ত পরিস্থিতি চলার পর, ২৫শে আগস্ট ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো।
গার্ডিয়ান: অর্ধসত্য। এটা ঠিক যে, এবারকার সহিংসতার পর্ব শুরু হয়েছিল ২৫শে আগস্ট সহিংস রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর আক্রমণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু উত্তর রাখাইনে কখনই ‘শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি’ ছিল না। এই হামলার আগেও, শ’ শ’ রোহিঙ্গাকে কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজে বা খাবার সংগ্রহে নড়তে দেয়া হচ্ছিল না। সেনাবাহিনী নিয়মিতই ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স’ চালাচ্ছিল, যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণঘাতীও ছিল। আবার রোহিঙ্গা জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও সন্দেহভাজন সরকারি গুপ্তচরদের হত্যা করার অভিযোগ ছিল।
সুচি’র বক্তব্য: দায় ভাগাভাগি করা বা দায়িত্ব পরিত্যাগ করা মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্য নয়। আমরা সব ক’টি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বেআইনি সহিংস ঘটনার নিন্দা জানাই।
গার্ডিয়ান: মিথ্যা। বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু মিয়ানমারের সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়া সরাসরি এই সংঘাতের দায় ‘চরমপন্থি সন্ত্রাসী’দের ঘাড়ে ফেলার চেষ্টা করেছে বারবার। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী বা জাতিগতভাবে বৌদ্ধদের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার নিন্দা জানানো হয়নি।
সুচি’র বক্তব্য: মানবাধিকার লঙ্ঘণ এবং স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি ও আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করার সব ধরনের কার্যকলাপ কঠোর বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসারে মোকাবিলা করা হবে।
গার্ডিয়ান: অর্ধসত্য। রাখাইন রাজ্যে মোতায়েনরত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার রেকর্ড খুবই কম। রোহিঙ্গাদের পেটানোর একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর, জানুয়ারিতে দেশটি চার পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায়। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে কিনা, সেটি স্পষ্ট নয়। সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে গঠিত একটি সরকারি কমিটি ‘তদন্ত’ শেষে জানায়, ওই অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন।
সুচি’র বক্তব্য: যাদেরকে নিজ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছে তাদের মধ্যে শুধু মুসলিম বা রাখাইন নয়, অনেকেই আছে। আছে কিছু ছোট সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যেমন দাইং-নেট, ম্রো (কামি), থেট, ম্রামাগ্যি ও হিন্দু। এদের উপস্থিতির ব্যাপারে পুরো বিশ্ব সম্পূর্ণই অন্ধকারে।
গার্ডিয়ান: সত্য। আন্তর্জাতিকভাবে নজর দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা গ্রাম পোড়ানোর দিকে, যেগুলোর সত্যতা সম্পর্কে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি দ্বারা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এবং নজর দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ২১ হাজার রোহিঙ্গার দিকে যারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, এমন রিপোর্টও এসেছে।
সুচি’র বক্তব্য: ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে কোনো সশস্ত্র সংঘাত চলছে না। চলছে না কোনো ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স’।
গার্ডিয়ান: মিথ্যা। গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা চলছেই। বাংলাদেশ থেকেও সেগুলো দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে গোলাগুলির আওয়াজ প্রায়ই শোনা গেছে রাখাইনে। এমনকি খোদ সু চি’র কার্যালয়ের ফেসবুক পাতায় বলা হয়েছে, ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স’ পরিচালনা করে আসছে।
সুচি’র বক্তব্য: মুসলিমদের ৫০ শতাংশ গ্রাম এখনও অক্ষত।
গার্ডিয়ান: অর্ধসত্য। রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংস করার প্রক্রিয়া অনেকটাই পদ্ধতিগত বা সিস্টেমেটিক। অনেক বড় এলাকায় হলে বাছবিচারহীনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি উদ্ধৃত করে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ২১৪টি গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে, সরকার বলেছিল যে, সেনাবাহিনীর যেসব গ্রাম টার্গেট করেছে, সেগুলোর ৪০ শতাংশ এখন খালি। সেখানে পোড়ানো তখনও থামেনি। রাখাইনে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের প্রবেশাধিকার মুক্ত না হওয়ায়, ঠিক কত শতাংশ গ্রাম ধ্বংস বা অক্ষত আছে, তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। আবার রাখাইনে সব মুসলিমই রোহিঙ্গা নয়। ফলে মুসলিম আর রোহিঙ্গাদের এক কাতারে আনার মাধ্যমে সুচি এখানে সংঘাতকে পরিসংখ্যানে প্রকাশ করে বিকৃত করার চেষ্টা করছেন।
সিএনএন এক্ষেত্রে আরেকটি বিশ্লেষণ দিয়েছে: সুচি নিজের বক্তব্যে একবারই রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। তবে তা-ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করতে নয়। তিনি আরসা জঙ্গি গোষ্ঠী অর্থাৎ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে বোঝাতে একবার ‘রোহিঙ্গা’ উচ্চারণ করেছেন। লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পেনি গ্রিন বলেন, ‘তিনি (সুচি) মূলত এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বোঝাতে। এর মানে হলো, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের একটি মাত্র পরিচয় হলো, তার মতে, সন্ত্রাসী। তিনি চান আন্তর্জাতিকভাবেও এই ধারণাটাই গৃহীত হোক।’
সুচি’র বক্তব্য: রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সকল মানুষের কোনো বৈষম্য ব্যতিরেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার রয়েছে।
গার্ডিয়ান: মিথ্যা। বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই মিয়ানমারে নাগরিকত্ব ও প্রয়োজনীয় সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত। স্বাস্থ্যসেবা খুবই সীমিত। অনেকেই বিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন না। বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণ শিবিরে থাকেন, তাদেরকে শিবির থেকে বের হতেই বিশেষ অনুমতি লাগে!
সুচি’র বক্তব্য: ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে, স্থানীয় ও বিদেশি গণমাধ্যমকে রাখাইনের এমন সব জায়গায় প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছে, যেগুলোতে আগে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। ২৫শে আগস্টের সংঘাত শুরুর পর থেকেও আমরা আক্রান্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি সাংবাদিক দলের সফরের ব্যবস্থা করেছি।
গার্ডিয়ান: অর্ধসত্য। সরকার সাংবাদিকদের জন্য সীমিত সংখ্যক সফরের আয়োজন করেছে। কিন্তু কিছু এলাকায় প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। সাম্প্রতিক সরকারি সফরের সময় বেশ কয়েকজন প্রতিবেদক খেয়াল করেছেন যে, রাখাইন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে।
সুচি’র বক্তব্য: মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে অনেকে আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা যে কোনো সময় যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরুর জন্য প্রস্তুত।
গার্ডিয়ান: অর্ধসত্য। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, সরকার শুধুমাত্র তাদেরই গ্রহণ করবে যাদের নাগরিকত্ব বা অন্য কোনো বাসিন্দা সনদপত্র রয়েছে। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে বহুবার সহিংসতার শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে জাতিগোষ্ঠী হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া হয় না। তাদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে কার্যত মিয়ানমারে তাদের ঐতিহাসিক অবস্থানকে অস্বীকার করা হয়। এ কারণেই রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন বলা হয়। অর্থাৎ, বর্তমান কাঠামোর অধীনে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব লাভের যোগ্য নন। তবে, সুচি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ‘যাচাইবাছাইকৃত’ শরণার্থীদের হয়তো ফেরানো হবে। এর এ-ও মানে হতে পারে যে, কেবল নাগরিক হলেই ফেরানো হবে, তা নয়।
সুচি’র বক্তব্য: অভিযোগ যেমন আছে, পাল্টা-অভিযোগও আছে।
গার্ডিয়ান: সত্য। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা চালানো হয়েছে, এমন দাবির স্বপক্ষে এখন বিপুল প্রমাণ রয়েছে। পোড়া দাগ বা গুলির ক্ষত নিয়ে বাংলাদেশে আসা অনেক শরণার্থীই সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবিতে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়ে ছারখার, কিন্তু প্রতিবেশী বৌদ্ধদের বসতি অক্ষত। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, রাখাইনে যা ঘটছে, তা ‘জাতিগত নিধনের আদর্শ উদাহরণ।’ অপরদিকে, সরকার ও তার সমর্থকরা সব কিছুর জন্য কেবল ‘সন্ত্রাসী’দের দায়ী করেছে।
সুচি’র বক্তব্য: আমরা এখন আরেক দফা মানবিক ত্রাণ প্রদান আরম্ভ করছি। আমরা আশা করছি, ওই অঞ্চলের সকল মানুষ এতে উপকৃত হবে।
গার্ডিয়ান: অর্ধসত্য। মিয়ানমার হয়তো খাবার, পানি ও ওষুধ বিতরণ শুরু করবে, কিন্তু আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধের কারণে অনেকে সরকারের নিন্দা জানিয়েছেন। যেমন, সংঘাত-উপদ্রুত এলাকায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকে প্রবেশ করতে দেয়নি সরকার। সম্প্রতি, রেডক্রস কমিটিকে সীমিত প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.