সেনা নিয়োগ করা বা না–করা

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ২২ ডিসেম্বর। নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল ছাড়াও আরও দলের বা নির্দলীয় প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দলীয় মনোনয়ন পেয়েই বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী এর প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মনে করেন। স্মরণ করা যায়, তিনিই পাঁচ বছর আগে নাগরিক সমাজের প্রার্থী হয়ে সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপুল ভোটে। সে সময়ে তাঁরও দাবি ছিল সেনা নিয়োগের। নির্বাচন কমিশনও সরকারের কাছে চাহিদা জানিয়েছিল এ মর্মে। তবে সেনা নিয়োগ হয়নি। তখন অনেকের ধারণা ছিল সরকারি দলের মূল অংশ সমর্থিত প্রবল প্রতাপশালী একজন প্রার্থী থাকায় সেনা নিয়োগ না হলে নাগরিক সমাজের প্রার্থী সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তা করেননি। ফলে সুফলও পেয়েছেন হাতে হাতে।
আর এবার সূচনাতেই সেনা নিয়োগের দাবিতে তাঁর বিরোধিতা একটু বেসুরো ঠেকছে। হতে পারে অতীত অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন কারও পক্ষে জনসমর্থন প্রবল হলে কোনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ভিন্নভাবে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, নির্বাচন এলেই এমনকি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রসঙ্গেও সেনা নিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। আর এ নিয়োগের দাবি জানায় সাধারণত বিরোধী দল। তবে সরকারি দলের লোকেরাও যে নির্বাচনে সেনা নিয়োগের দাবি জানান তা এবার রাঙামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা ইউনিয়ন পরিষদসমূহের নির্বাচনে দেখা গেল। তাহলে মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়, যাঁরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য বা কোনো না কোনোভাবে সবল, তাঁরা সেনা নিয়োগের বিপক্ষে থাকেন। আর অন্যেরা দাবি জানাতে থাকেন এর পক্ষে। কারণও কারও অজ্ঞাত নয়। কোথাও বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি আর কোথাও-বা তাদের ওপর ক্ষমতায় থাকা দলের প্রভাবের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। গত দুই যুগে বেসামরিক প্রশাসনে অব্যাহত দলীয়করণের ফলে তাদের ওপর অন্য পক্ষের আস্থার ঘাটতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। এমনকি নির্বাচন কমিশন নিজেদের বিতর্কিত করে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এ ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির প্রত্যাশায় এটা চাওয়া হয়, এমনটা বলা চলে। তবে বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন দেশব্যাপী একই দিনে হয় বলে বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে মানসম্পন্ন নিরাপত্তা বিধান সম্ভব নয়।
তাই ঐতিহ্যগতভাবে সে নির্বাচনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সামরিক বাহিনী ডাকা হয়। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা সংসদের কোনো আসনের উপনির্বাচন সারা দেশে একই দিনে হয় না। এগুলোর আইনশৃঙ্খলার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা বেসামরিক প্রশাসনের রয়েছে। সাধারণত তা-ই করা হয়। তবে ব্যতিক্রমও হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একবার সীমিত আকারে সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছিল। আবার সে সময়কালে ঢাকা মহানগরীর একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে এবং ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কমিশন চাওয়া সত্ত্বেও সেনা মোতায়েন করা হয়নি। প্রয়োজন ছিল কি না সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এ দাবি প্রতিপালন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। এতে কমিশনের পাশাপাশি সংবিধান উপেক্ষিত হয়েছে। এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। সামরিক বাহিনী মোতায়েন করলেই কি সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তার বিধান করা যায়? নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা কিন্তু মিশ্র। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দলগুলো প্রায় সমষ্টিগতভাবে তা বর্জন করে। ফলে সে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ এক মাসও টেকেনি। তেমনি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও সামরিক বাহিনী মোতায়েন ছিল। এ ক্ষেত্রেও প্রধান বিরোধী দলসহ তাদের জোট নির্বাচন বর্জন করে। এর ফলাফল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতো না হলেও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেছে। আবার এ দেশের সর্বজনপ্রশংসিত নির্বাচনগুলোর পরিচালনায়ও অংশীদার ছিল সামরিক বাহিনী। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সূচনায় সামরিক বাহিনী ব্যতিরেকেই কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করে।
তাহলেও ধরে নিতে হবে যেখানে তাদের ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা যায়, সেখানে সেনা তলবের দাবি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নারায়ণগঞ্জ ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর এবং এখানকার বয়নশিল্পের সমৃদ্ধির জন্য প্রাচ্যের ডান্ডি নামে পরিচিত ছিল। ব্যবসা ও শিল্পের সমৃদ্ধির জন্য নগরায়ণ এখানে আগেই হয়েছে। ১৭৬৬ সাল থেকেই এটি শহর এলাকা বলে সরকারি স্বীকৃতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাদি ছিল। নারায়ণগঞ্জের সে সমৃদ্ধি ছিল ক্রমবিকাশমান। এরই ধারাবাহিকতায় সাড়ে চার বর্গমাইল এলাকায় প্রায় ২৮ হাজার লোকের সমন্বয়ে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা। বয়নশিল্পসহ নানা শিল্পের প্রসার ঘটেছে এ জনপদ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে। এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিলস ছিল নারায়ণগঞ্জে। সাম্প্রতিক কালে কিছু চাঞ্চল্যকর সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এ জনপদের নেতিবাচক ভাবমূর্তিও আলোচনায় এসেছে দেশব্যাপী। নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছাকাছি এ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুলেও পৌরসভা ছিল। এ তিনটির সমন্বয়ে ২০১১ সালের ৫ মে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। এর আয়তন ৭২ দশমিক ৪৩ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা ৭ লাখের কিছু বেশি। তিনটি জোনে বিভক্ত এ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডের সংখ্যা ২৭। সুতরাং অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হলেও সিটি করপোরেশনের আয়তন ও জনসংখ্যা তেমন বেশি কিছু নয়। এর নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা বেসামরিক প্রশাসনের রয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বেসামরিক প্রশাসনের সামর্থ্য এসব নির্বাচন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট। সফলও হয় নির্বাচন। এরশাদের শাসনকাল শেষ হওয়ার পর প্রথম বিএনপি সরকারের সময়কালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুজন ডাকসাইটে নেতা মেয়র নির্বাচিত হন। অন্যদিকে মাগুরায় সংসদের একটি উপনির্বাচনে সরকারি দলের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ দেশের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। আবার চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও চট্টগ্রামে মেয়র পদে হ্যাটট্রিক করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। ঠিক তেমনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, গাজীপুর ও কুমিল্লায় সিটি করপোরেশনসমূহের মেয়র পদে নির্বাচিত হন বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা। নারায়ণগঞ্জেও আওয়ামী লীগের তখনকার মূল স্রোতোধারার প্রার্থী হেরে যান সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে। অবশ্য তখন আইনগতভাবে নির্বাচন নির্দলীয় ছিল। তবে এসব সময়েই উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়। বিতর্কিত হয় হালের ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনও। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের ক্ষমতাকাঠামোয় সরকারের ভূমিকা প্রবল পরাক্রমশালী।
রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ওপর নির্ভরশীল। কমিশনকে জনবলের জন্য সর্বতোভাবে নির্ভর করতে হয় সরকারের ওপর। এ থেকে পরিত্রাণ ঘটানোর নামে ইতিমধ্যে কমিশনের জনবল কয়েক গুণ করে ফেলা হয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব কমিশন কর্মকর্তাদের দেওয়া হচ্ছে। তবে যেখানে কমিশন নিজেই বিতর্কিত আর প্রশ্নবিদ্ধ তাদের সক্ষমতা, সেখানে তাদের অধীন কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন, এমনটা আশা করা সংগত নয়। তার ওপর স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় সহায়তা ছাড়া সফল নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তবে আমরা সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্তে আলোর ক্ষীণ রশ্মিও দেখতে পাচ্ছি। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এটা ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় বিএনপি সে নির্বাচনে অংশ নেবে। ইতিমধ্যে তারা আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া লক্ষণীয় হচ্ছে না। তবে আগামী নির্বাচন সফল করতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তাতে সরকারের ভূমিকাই বেশি। নারায়ণগঞ্জেও আমরা কিছু ইতিবাচক দিক লক্ষ করছি। দুটি প্রধান দলের প্রার্থী দুজন ব্যক্তিগতভাবে সজ্জন বলে পরিচিত। সুতরাং তাঁরা পেশিশক্তি ও কালোটাকার ওপর নির্ভরশীল হতে চাইবেন না, এমনটা আশা করা যায়। আর বর্তমান কমিশন শুরুটা ভালোই করেছিল। তাদের মেয়াদকাল প্রায় শেষ। তাই শেষটাও ভালোভাবে করার একটি প্রত্যয় তাদের থাকতে পারে। কথায় আছে, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.