আর কত দিকে আগুন জ্বলতে দেখব?

সাঁওতাল বস​ি​ততে পুলিশের উপস্থিতিত
 অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে
নাসিরনগরের আগুনের ধোঁয়া সরতে না সরতে আগুন জ্বলে উঠল গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালপল্লিতে। নাসিরনগরে আগুনবাজদের দেখে পুলিশ সরে গিয়েছিল। গোবিন্দগঞ্জের পুলিশ অতটা দায়িত্বহীন হতে পারেনি। তারা সরেজমিন খাড়া থেকে আগুন লাগানো নিশ্চিত ও নির্বিঘ্ন করেছে। দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে গুলি করেছে। তাতে তিনজন আহত এবং একজন নিহত বলে জানা গিয়েছিল। নিহত ব্যক্তির নাম শ্যামল হেমব্রম। নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ১৫ জন। তাদের একজনের লাশ সোমবার ধানখেতে পাওয়া গেছে। ওই ধানখেতটাও ওই লাশ হওয়া মানুষটার পূর্বপুরুষের। সেই জমিতে তারা যেসব ঘর তুলেছিল, গাছ লাগিয়েছিল, সব পুড়ে ছাই। খড়ের চাল পোড়ে, দরজা-জানালা পোড়ে, জামাকাপড়, চৌকি-বিছানা পোড়ে। মাটি তো আর পোড়ে না। তাই ট্রাক্টর এনে ভাঙা ঘরের পোড়া মাটিও গুঁড়িয়ে সমান করা হয়েছে। পোড়াপুড়ি, হামলা, গুলি সব রোববার সন্ধ্যার মধ্যে শেষ। হামলাকারী ও পুলিশেরাও তো মানুষ। তাদের বিশ্রাম দরকার হয়। তাই রোববার রাতে তারা ফিরে যায়। আর সাঁওতালেরা সম্ভবত ঠিক মানুষ নয়। ঘরপোড়ার দল সে রাতে কোথায় ঘুমিয়েছে, তাদের শিশুরা খেতে পেয়েছে কি না, এসব কোনো প্রশ্ন নয়।
আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিষয়টিও কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয় সারা রাত। চেষ্টা করা হয় গ্রেপ্তার করে গাইবান্ধায় নিয়ে যাওয়ার। পরে গণমাধ্যমে খবর রটে গেলে চিকিৎসা শুরু হয় বটে, কিন্তু হাতকড়া আর খোলে না। সোমবার সকালে আবার শুরু হয় হামলা। এবার পাশের মাদারপুর গ্রামে। ঘরে যা ছিল সব নিয়ে গেছে, গোয়ালের গরু-ছাগল, ঘরের টিনের চাল, জমি চাষের পাওয়ার টিলার—সব। নাসিরনগরের ইউএনওর মতো গোবিন্দগঞ্জের ইউএনও মো. আবদুল হান্নানও খুবই দায়িত্বশীল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো বিষয়ে কথা বলতে পারব না। খুব ব্যস্ত।’ ফোন কেটে দেন। আর গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত সরকার দেখেশুনে অজ্ঞ হয়ে গেছেন। তাঁর সাফ কথা, ‘হামলা নিয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি আমাদের কাছে। এমন ঘটনা জানা নেই।’ (প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর, অনলাইন সংস্করণ) সাঁওতাল গ্রাম পোড়ানো কোনো নতুন ঘটনা নয়। শতবর্ষজুড়েই ঘটছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে পার্বতীপুরের চিড়াকুটার সাঁওতাল কৃষকেরা তাদের জমি দখল ঠেকাতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সেবার সাঁওতালি তিরে এক বাঙালির প্রাণ যায়।
যথারীতি পুলিশ এসে ২৩ সাঁওতালকে আটক করে। পুলিশ যাওয়ামাত্রই চারপাশের হাজার হাজার বাঙালি নামধারী ‘পিঁপড়ার মতো আসি’ ঘরদোর লুট করে, বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, ছিনিয়ে নেয় গবাদিপশুসহ অস্থাবর সব সম্পদ। প্রতিকার হয়নি কোনো। এখন সাঁওতালদের সবই কম। তাদের জমি কম, রক্ত কম লাল, চোখের পানি কম নোনা, অত্যাচার-নির্যাতনও যেন তাদের গা সওয়া। কমই যদি না হবে, তাহলে এত সহ্য করে কীভাবে? বাঙালির পক্ষে বাঙালি থাকে, মুসলমানের ডাক আরেক মুসলমানে শোনে, হিন্দু ও খ্রিষ্টানদেরও সহায়-শক্তি আছে দেশে-বিদেশে। কিন্তু সাঁওতালদের কিছুই নেই। এক গ্রামের সাঁওতাল উচ্ছেদ হলে আরেক গ্রামের সাঁওতালেরা তাদের আশ্রয় দিতে ভয় পায়। যদি আশ্রয় দেওয়ার দায়ে তাদের ওপরও হামলা-গ্রেপ্তার নেমে আসে? এত ‘নেই’-এর মধ্যেও খুব করে ‘আছে’ তাদের গায়ের রং, চেহারার ধাঁচ আর সাঁওতালি ভাষার বুলি। এই থাকাতেই মস্ত বিপদ। হোটেল-রেস্তোরাঁয় তাদের পাতে কেউ খায় না। তাদের কোনো যুবকের স্বজাতির বাইরের কাউকে ভালোবাসা মানে মৃত্যু ডেকে আনা। তাদের মর্যাদা ও সম্পত্তি দুটোই যেন লুটপাটের বিষয়। যে পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের জমি কেড়েছিল, একাত্তর সালের ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে তাদের হাতেই শয়ে শয়ে জীবন দিয়েছিল সাঁওতালেরা।
দুই. সাঁওতালেরা এই ভূখণ্ডের প্রাচীনতম অধিবাসী। বাঙালির ইতিহাসে সাঁওতালের উত্তরাধিকার মিশে আছে। উত্তরবঙ্গে একসময় তাদের বিপুল জমি ছিল। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষা না থাকায়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির কায়দাকানুন না বোঝায় ধীরে ধীরে সব চলে গেছে। দিনাজপুর, রংপুরের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিনিকল ইত্যাদি সেই পাকিস্তান আমল থেকেই সাঁওতালদের জমি অধিগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফুলবাড়ীর বুকচিতে দেখেছি, দিনাজপুরে সরেজমিনে দেখেছি জমি দখল নিয়ে অজস্র সাঁওতাল কৃষকের অভিযোগ। গত বছর ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দিনাজপুর শহরের সাঁওতাল সমাবেশে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি অনুসন্ধানের ভিত্তিতে দাবি করলেন, ৮০ শতাংশ সাঁওতালি জমি নিয়েই গন্ডগোল চলছে। গোবিন্দগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট একসময় সাঁওতাল ও পাহাড়িয়া জাতি-অধ্যুষিত এলাকা ছিল। বাগদা সরেন নামে এক সাঁওতাল জমিদারও ছিলেন। জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদের পর ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের ১৫টি সাঁওতাল আর ৫টি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ করে ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার। জমির মালিকদের ভাষ্য, সরকার জমির কোনো মূল্য দেয়নি। কেবল জমির শস্য, বসতবাড়ির গাছপালা, কুয়া ও ঘরবাড়ির একটা মূল্য ধরে দেয়। তা-ও মাত্র ৮ লাখ ৭ হাজার ৩১৮ টাকা! এর ছয় বছর পর ভূমিহারাদের সঙ্গে সরকারের একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয় অধিগ্রহণকৃত জমি আখ চাষের বদলে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হলে সরকার ওই জমি পূর্বতন মালিকদের ফেরত দেবে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার দরুন ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় চালু ও বন্ধ হওয়ার মধ্যে থাকছে এই রাষ্ট্রীয় চিনিকল। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ জমি তামাক, ধান ও ভুট্টা চাষের জন্য বাণিজ্যিকভাবে ইজারা দেওয়া আছে। জমির আদি মালিক সাঁওতাল ও বাঙালিদের আপত্তি এখানেই। যেহেতু চিনিকল ঠিকঠাক চলছে না এবং আখের বদলে অন্য শস্য চাষ হচ্ছে, সেহেতু তাঁরা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জমি ফেরত চান।
এদিকে সংসদীয় কমিটি বলেছে বিষয়টি আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা। কিন্তু গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন জমি ফেরত দেওয়ার বদলে ওই এলাকায় ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ করার প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের কাছে। অথচ প্রস্তাবিত কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০১৬ অনুযায়ী কোনোভাবেই কৃষিজমিতে শিল্পাঞ্চল করা যাবে না। এমনকি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইনেও অনুরূপ কথা আছে। সুতরাং গোবিন্দগঞ্জের আদিবাসী সাঁওতালেরা আইনের পথেই ছিল। তাদের উচ্ছেদ, গুলি, ঘরবাড়ি পোড়ানো ও বিতাড়নের অধিকার তাই সরাসরি জুলুম ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ভূমি দখল ও অধিগ্রহণের বিরাট আয়োজন চলছে। সরকার করছে যত, ভূমিদস্যুরা করছে তার চেয়েও বেশি। দরিদ্র আদিবাসী কৃষকদের উদ্বাস্তু করে, জীবিকা কেড়ে নিয়ে দরিদ্র বাড়ানো এবং কৃষিজমি নষ্ট করে খাদ্যনিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি কেমনতর উন্নয়ন? এক কূল ভেঙে আরেক কূল গড়ার এই উন্নয়ন ভারসাম্যহীন। আমেরিকায় একসময় স্বর্ণশিকারিরা সোনার সন্ধানে দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি ও গোলাগুলি করত। এর নাম হয়েছিল গোল্ড রাশ। বাংলাদেশে এখন চলছে ল্যান্ড রাশ তথা ভূমিগ্রাসের ছিনিমিনি খেলা। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা নিরসনে একটা ভূমি কমিশন সরকার গঠন করেছে। সমতলের আদিবাসীদের জমির ব্যাপারে অনুরূপ কমিশন গঠনের অঙ্গীকার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল। পাকিস্তান সরকার করেছিল চুক্তি, আওয়ামী লীগ সরকার করেছে অঙ্গীকার; কিন্তু কথা রাখার দায় নেয়নি কেউই। তার বদলে আগুন জ্বালানো হয়েছে। আর কত দিকে আগুন জ্বলে উঠতে দেখব আমরা?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
faruk.wasif@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.