পুঁজি, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন

পুঁজি বিত্তবানদের হাত থেকে দরিদ্র মানুষের কাছে স্থানান্তরিত হলেই শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন হবে- সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিবিদদের এই ধারণাটি পুঁজির স্বাভাবিক চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ পুঁজির ধর্মই হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা কতিপয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়া। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, পুঁজির ধর্ম হচ্ছে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে বিত্তবানদের ভাণ্ডারে কেন্দ্রীভূত হওয়া। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিবিদরা সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বিপরীত স্রোতে ধাবিত করতে চান। অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবক্তারা মনে করেন, যিনি সৃজনশীলতা প্রয়োগ করে পুঁজি আহরণ করবেন, এর উপর সম্পূর্ণ অধিকার তারই। এখানে রাষ্ট্র বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। কারণ ইচ্ছা করলেই সবাই বিত্ত আহরণ করতে পারেন না। এটা একটি বিশেষ যোগ্যতাও বটে। তাই যিনি নিজ যোগ্যতা বলে সম্পদ আহরণ করবেন তিনি তার ভাগ কেন অন্যকে দেবেন? তারা আরও বলেন, পুঁজির স্বাভাবিক যে প্রবণতা অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে বিত্তবানদের ভাণ্ডারে স্থানান্তরিত হওয়া, সেটাও সব সময় খারাপ নয়। কারণ বিত্তবানরাই জানে কিভাবে পুঁজির সর্বোত্তম ব্যবহার বা প্রয়োগ নিশ্চিত করে আরও সম্পদ তৈরি করা যায়। সম্পদই সম্পদ সৃষ্টি করে এটা তারা বিশ্বাস করে। প্রচুর টাকা একজন সাধারণ দরিদ্র মানুষের কাছে প্রদান করা হলেই তিনি অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন সাধন করতে পারবেন এমনটি নাও হতে পারে। কারণ পুঁজি কিভাবে আরও লাভজনকভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটা তার জানা নাও থাকতে পারে।
কিন্তু যিনি বিত্তবান তিনি বিত্ত আহরণের কোনো না কোনো কৌশল সম্পর্কে জ্ঞাত আছেন। কাজেই তিনি চেষ্টা করলেই প্রাপ্ত নতুন পুঁজি ব্যবহার করে আগামীতে তার বিত্ত আরও স্ফীত করতে পারবেন। এছাড়া সম্পদ বা পুঁজি সামান্য বিত্তবান মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়াটাও সব সময় খারাপ নয়। কারণ বিত্তবানের হাতে যদি পুঁজি সঞ্চারিত হয় তাহলে তিনি তার কোনো অপব্যবহার করবেন না, বরং তিনি এই পুঁজিকে বিত্ত বাড়ানোর কৌশল হিসেবে কাজে লাগাবেন। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। সাধারণ দরিদ্র মানুষ বিত্তবানের সৃষ্ট শিল্প-কারখানায় কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান কিছুটা হলেও উন্নত করতে পারবেন। অন্যদিকে পুঁজি যদি সাধারণ দরিদ্র মানুষের হাতে পতিত হয় তাহলে তার অপব্যবহার হওয়ার আশংকা থাকে। কারণ সাধারণ দরিদ্র মানুষের মৌলিক ভোগ চাহিদা বেশি থাকায় তারা প্রাপ্ত পুঁজি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না করে ভোগবিলাসে ব্যয় করতে পারেন। কারণ সাধারণ মানুষ সব সময়ই মৌলিক ভোগ চাহিদাজনিত সংকটে ভোগেন। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য রেমিটেন্স আয় করেছে। গত অর্থবছরেও সমপরিমাণ বা তারও বেশি রেমিটেন্স অর্জন করবে বলে আশা করা যায়। এই বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্সের প্রায় সবটুকুই এসেছে গ্রামাঞ্চল থেকে বিদেশে গমনকারী দরিদ্র মানুষের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। তারা বিদেশে ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠিয়েছেন।
কিন্তু স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিরা সেই টাকা খুব বেশি উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করেননি। বরং তারা এ অর্থ দিয়ে ফ্রিজ, টেলিভিশন বা এ ধরনের বিলাস সামগ্রী ক্রয় করেছেন। তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থান বাড়ানোর জন্য যা কিছু করা দরকার তার সবই করেছেন। জমি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন। প্রচুর ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রাপ্ত অর্থের পুরোটাই তারা নানা অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু শিল্প-কারখানা স্থাপন করে এই পুঁজির দ্বারা ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নতির পথ সুগম করেননি। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার বর্তমান অবস্থায় দৃশ্যত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করলেও তারা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তেমন কিছুই রেখে যেতে পারছেন না। এমনকি দেশ ও জাতির জন্যও তাদের অবদান খুবই সামান্য। কিন্তু এই রেমিটেন্স যদি কোনোভাবে দেশের বিত্তবানদের হস্তগত হতো, তাহলে তারা তা দিয়ে নানা ধরনের শিল্প-কারখানা স্থাপন করতেন। এই শিল্প-কারখানা স্বীয় পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণেও ব্যবহৃত হতে পারত। কারণ এসব শিল্প-কারখানায় প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারত। কাজেই পুঁজি শুধু দরিদ্র মানুষের হাতে গেলেই তা কল্যাণ বয়ে আনবে তা নাও হতে পারে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুঁজি বিত্তবানদের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার মধ্যেও কল্যাণ নিহিত থাকতে পারে। অবশ্য নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে পুঁজির ব্যবহার কোনোভাবেই কল্যাণজনক হতে পারে না। আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনা করি তাহলে যে চিত্র পাই, তা কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশে পুঁজি স্থানান্তরের মিশ্র প্রভাব লক্ষ করা যায়।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে বিত্তবান ও বিত্তহীনের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র দু’জন। বর্তমানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা সঠিকভাবে কেউই বলতে পারবে না। কারণ অবৈধপথে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন। যাদের আয় দিয়ে দিন চলার কথা নয় তারাও কোটিপতি হয়েছেন। দেশের অর্জিত সম্পদ সামান্য কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আমরা যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছি তার সুফল সবাই পাচ্ছে না। আগে গ্রাম থেকে পুঁজি শহরের দিকে ধাবিত হতো। কিন্তু এখন পুঁজি শহর থেকে গ্রামের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। তারপরও জাতীয় অর্থনীতিতে শহরের অবদান এখনও বেশি। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৯ শতাংশ গ্রামে বাস করে। কিন্তু অর্থনীতিতে এখনও শহরের অবদান ৬০ শতাংশের বেশি। পুঁজি বিত্তবানদের হাতে পুঞ্জীভূত হলে উৎপাদনশীল খাতে তা ব্যবহৃত হবে- পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের এই সাধারণ ধারণা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। দেশের সামান্য কিছু মানুষের হাতে পুঁজির পাহাড় গড়ে উঠছে ঠিকই, কিন্তু সেই পুঁজি স্থানীয়ভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বরং তা দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই পাচারকৃত টাকা আর কখনোই উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমাকৃত টাকা ১০ শতাংশ বেড়েছে এক বছরের ব্যবধানে। সুইজারল্যান্ডে যে টাকা জমা হয়েছে তার সবই অবৈধভাবে উপার্জিত বলে মনে করা যেতে পারে। বস্তুত বৈধ বা অবৈধ পথে কিছু মানুষের হাতে প্রচুর টাকা পুঞ্জীভূত হচ্ছে। কিন্তু এ টাকা দেশের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না হয়ে পাচার হচ্ছে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের দেয়া সূত্রানুযায়ী, পুঁজি বিত্তবানদের হাতে সঞ্চারিত হলেই যদি বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পাওয়া যেত তাহলে বাংলাদেশ তো বিনিয়োগে ভরে যেত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পুঁজি বিনিয়োগের জন্য সাধারণ যেসব শর্ত পরিপালিত হতে হয় তার বেশির ভাগই আমাদের দেশে অনুপস্থিত। তাই চেষ্টা করলেও বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় হচ্ছে না। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মাধ্যমে যে পুঁজি গঠিত হয় তা বিনিয়োগের জন্য প্রচলিত বিনিয়োগ সুবিধার বাইরেও কিছু বিশেষ সুবিধা দিতে হয়। যেমন, তাদের উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগকালে উপার্জনের পদ্ধতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না এ ধরনের একটি নিশ্চয়তা তারা আশা করে। কোনো কারণেই পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা হবে না এটাও তারা কামনা করে। বাংলাদেশের বিত্তবানদের মাঝে কিছুটা হলেও নেতিবাচক অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে পল্লী এলাকা থেকে শহরে পুঁজি প্রবাহিত হতো। সেই পুঁজি শহরে এসে নানা ধরনের শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ হতো। কিন্তু এখন শহর থেকে পুঁজি গ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু সেই পুঁজি ভোগবিলাসে যতটা ব্যবহৃত হচ্ছে ততটা বিনিয়োগে আসছে না। অন্যদিকে শহুরে মানুষের কাছে যে পুঁজির পাহাড় গড়ে উঠছে, তা স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ না হয়ে দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের মতামত ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। চূড়ান্ত বিবেচনায় আমরা বলতে পারি, পুঁজি শুধু বিত্তবানদের হাতে গেলেই তা বিনিয়োগের নিশ্চয়তা বিধান করে না। এজন্য আরও অনেক কিছু করার আছে।
এমএ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.