পুরোনো প্রতিবেশী, নতুন সম্পর্ক

অং সান সু চির চীন সফরের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মিয়ানমার সফর করলেন। মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটাই প্রথম ভারতের কোনো নেতার উচ্চপর্যায়ের মিয়ানমার সফর। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমার এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তবে জান্তা আমলের আইন অনুসারে সু চি প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও সরকারের ওপর তাঁর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। জান্তার আইন অনুসারে, যাঁর স্বামী বা সন্তানের বিদেশি নাগরিকত্ব আছে, তিনি দেশের নির্বাহী পদে আসীন হতে পারবেন না। আর সু চির ছেলেদের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব রয়েছে। সুষমা স্বরাজের এই সফরের আগে ভারতের সেনারা মিয়ানমারের সীমানায় ঢুকে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এতে বোঝা যায়, এই দেশ দুটির মধ্যে সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহ মোকাবিলায় ঐকমত্য রয়েছে। স্বরাজের এই সফরে মিয়ানমার নিজের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে: সে তার ভূমি ভারতবিরোধী কাজে ব্যবহৃত হতে দেবে না। আর স্বরাজ সু চিকে আশ্বস্ত করেছেন, ভারত তাদের ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সব ধরনের সহযোগিতা’ করবে।
সব পরাশক্তিই এখন মিয়ানমারের দ্বারস্থ হচ্ছে, ফলে ভারতীয় কূটনীতির সামনে কঠিন সময়। ওদিকে সু চির চীন সফরের সময় চীন ও মিয়ানমার ‘রক্তের ভাই’ হিসেবে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে। তবে চীনের উদ্বেগের মূল কারণ হচ্ছে, ৩৬০ কোটি ডলারের মিতসোন বাঁধ প্রকল্প। পরিবেশবাদীদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এই বাঁধের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। যদিও সু চি তখন এর নির্মাণকাজ স্থগিতের দাবি জানিয়েছিলেন, এবার তিনি বেইজিংকে আশ্বস্ত করেছেন, দ্রুতই এর ফয়সালা করা হবে। কারণ, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের চীন সীমান্তে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কাজ করছে, তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য চীনের সহায়তা জরুরি। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের নতুন সরকারের ওপর সেনা প্রভাব ও রোহিঙ্গাসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে মিয়ানমারের অবস্থানের কারণে উদ্বিগ্ন, তারা মিয়ানমারের ওপর থেকে প্রায় তিন দশকের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ওবামা প্রশাসন মিয়ানমারের এই গণতান্ত্রিক উত্তরণকে তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে মনে করে। এদিকে ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। ভারত মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ব্যাপক সমালোচনা করেছে। ভারতের ক্ষমতাশালীরা অং সান সু চির স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রশংসাও করেছেন।
তবে ১৯৯০-এর দশকের মধ্য ভাগে ভারত ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করায় সে জান্তার সমালোচনা করা ছেড়ে দেয়। সু চির প্রতি মৌখিক সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ভারতের গণতন্ত্রপ্রীতির কারণে মিয়ানমার একসময় চীনের দিকে ঘেঁষে যায়। ভারত দ্রুতই বুঝে যায়, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, জ্বালানি ও সহযোগিতা বেড়ে গেছে। চীন অস্ত্র থেকে শুরু করে খাদ্যশস্য সবই মিয়ানমারের কাছে বিক্রি করতে শুরু করে। চীনা কোম্পানিগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মিয়ানমারের গ্যাস ব্লকের ইজারা পেতে শুরু করে। তার কারণ হচ্ছে, চীন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমার-বিষয়ক পদক্ষেপের বিরোধিতা করায় তারা এই পুরস্কার পায়। ভারত বুঝে যায়, মিয়ানমারে চীনের নৌশক্তির উপস্থিতি বাড়তে থাকলে ভারত মহাসাগরে তার শক্তি প্রদর্শন করা কঠিন হয়ে উঠবে। ফলে ভারত পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। মিয়ানমার-বিষয়ক তার বহু পুরোনো নীতি বদলে ফেলা ছাড়া ভারতের আর তেমন কিছু করার ছিল না। জান্তাকে একঘরে করার নীতি থেকে বেরিয়ে এসে সে তার সঙ্গে আরও বেশি করে যুক্ত হয়। তা ছাড়া, ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য মিয়ানমারকে কিছুটা গণতন্ত্রমুখী করা দরকার ছিল। ২০০৮ সালে নার্গিস সাইক্লোনের পর ভারত মিয়ানমারকে সহায়তা করলে সে দেশটির অভিজাত ক্ষমতাচক্রের আস্থা লাভ করে।
সে যে এটা হারাতে চায়নি, তা ঠিকই আছে। ফলে ভারত যে মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কয়েক বছরের আলোচনার পর ভারত ২০০৮ সালে সিতওয়ে বন্দর নির্মাণে রাজি হয়, যেটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার নতুন পথের সন্ধান দেয়, যাতে আর বাংলাদেশ হয়ে যেতে না হয়। এ ছাড়া থানলিন রিফাইনারির সংস্কারের জন্য ভারত মিয়ানমারকে দুই কোটি ডলারের ঋণ দেয়। ২০০১ সালে নির্মিত ১৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভারত-মিয়ানমার মৈত্রী সড়ক ছাড়াও ভারত দ্বিতীয় সড়ক প্রকল্পের কাজ করছে, সাগর সমৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। আর পশ্চিম মিয়ানমারের শিউ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পেও কাজ করছে সে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে মিয়ানমার নাগা বিদ্রোহীদের দমনে ভারতকে সহযোগিতা করেছে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ হওয়ায় ভারতের কৌশলগত কারিগরি সহায়তা করার সুযোগ আরও বেড়েছে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন কিউ বলেছেন, ‘গণতন্ত্র বলতে আসলে কী বোঝায়, তা বুঝতে হবে ভারতকে দেখে।’ সুষমা স্বরাজের সফরের সময় তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, অতীতের মতো এখনো ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক শুধু গণতন্ত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া।
হর্শ ভি পান্ট: লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.