ছেলেশিশুকে রান্নাবাটি খেলতে শেখান

জীবনসঙ্গীর প্রতি কর্মজীবী নারীর অনেক অভিযোগ। গৃহব্যবস্থাপক নারীকেও মুখ বুজে অনেক কিছু হজম করতে হয়। অভিযোগের মধ্যে অন্যতম, ঘরের কাজে পুরুষ হাত দিতে চান না। ভাবেন, ওটা নারীদের একচেটিয়া। কিন্তু যে নারী তাঁর সঙ্গী পুরুষটির মতোই কর্মক্ষেত্রে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ঘরে ফেরেন, তাঁরও তো শরীর। না, তাঁকে ঘরে ফিরেই সঙ্গীর হুকুম তামিল করতে হবে। রান্নাবান্না, খাবার পরিবেশন, সন্তান ও বয়স্কদের দেখাশোনা, অতিথি আপ্যায়ন, ঘর গোছানো—সবই নারীর কাজ। এসব কি নারীশরীরের মতোই ঈশ্বর-নির্ধারিত? নারীকে এসবের দায়িত্ব কে দিয়েছে? এই সমাজ, এই পুরুষসমাজ। পুরুষেরও দুটি হাত, নারীরও। কোনো কাজ পারা না-পারা অভ্যাস ও অনুশীলনের বিষয়। একসময় যখন নারীরা শুধুই ঘরের কাজ করতেন, তখন না হয় এসব অত্যাচার কিছুটা মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু স্বনির্ভর-সচেতন নারীর প্রশ্নের কী জবাব দেওয়া যাবে? তাঁদের বোঝালে তো চলবে না যে এগুলো পুরুষের কাজ, ওগুলো নারীর। যুক্তি কোথায়? জেন্ডার ধারণার উন্মেষ ও বিকাশের ধারাবাহিকতায় নারী বুঝতে শিখেছেন ধর্ম-সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জায়গাটা পাকা করে রাখার জন্য ক্ষমতাধর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আরোপিত অনুশাসন ছাড়া এখানে অন্য কোনো বিধিবিধান নেই। উন্নত বিশ্বে তালাকের হার অনেক বেশি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ তালাকই নাকি নারীর তরফ থেকে আসে। কেন?
প্রধান কারণগুলোর মধ্যে পুরুষ সঙ্গীরা এখনো নারী সঙ্গীর কাছে সংসারের সব কাজ ও সন্তান লালনের যাবতীয় কর্তব্য আশা করেন। বিয়ে বিশেষজ্ঞ ড. উইলিয়াম এইচ ডরোথির মতে, আমেরিকায় ৭৩ শতাংশ বিয়েই ভেঙে যায় অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে। অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে অন্যতম সংসার ও সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব ভাগাভাগির ব্যাপারে পুরুষ সঙ্গীর অপারগতা। এই সেদিন একজন নারীবিষয়ক গবেষক বলছিলেন, নারীদের আত্মত্যাগের কারণেই সংসারগুলো টিকে আছে। তিনি শিক্ষিত, কর্মজীবী নারীদের সংসারের দিকেই মূলত ইঙ্গিত করেছিলেন। এখনো আমাদের মজ্জায়-মননে নারী-পুরুষের শ্রমবিভাজনের ধারণা সমানভাবে বিদ্যমান। এমনকি শিক্ষিত নারীও ভাবেন, পুরুষের পেশিবহুল হাত সংসারের কোমল কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত নয়। একজন উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী মা বিদেশে ছেলের বাসায় গিয়ে দেখেন, পুত্রবধূ রান্না করছেন আর পুত্র বাসন মাজছেন। দেখে তিনি আড়ালে চোখের পানি মুছে পুত্রের হাত থেকে বাসনপত্র কেড়ে নিয়ে ‘এসব কি পুরুষ মানুষের কাজ?’ বলে নিজেই লেগে পড়লেন সে কাজে। যেমনটি পোশাকশিল্প কারখানায় নমনীয় আঙুলকে সুই-সুতোর সূক্ষ্ম কাজের উপযোগী বিবেচনা করে নিম্ন মজুরির শ্রমিক পর্যায়ে কেবল নারীকেই নিযুক্ত করা হয়। অপরদিকে শ্রমবিভাজনের প্রচলিত প্রথায় কৃষিকাজ বা নির্মাণশ্রমে পুরুষের একাধিপত্য বিবেচনা করা হলেও নারীকে এসব কাজে অন্তর্ভুক্ত করাতে সুবিধাভোগী পুরুষ সম্প্রদায়ের উৎসাহের কমতি নেই।
কিন্তু নারীর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ নৈব নৈব চ। জেন্ডার সমতায় বিশ্বাসী স্বামীও বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘আমি ঘরের কাজে আমার স্ত্রীকে সাহায্য করি।’ আহা! যেন ঘরটা কেবল তাঁর স্ত্রীর। তিনি সাহায্য করে নারী জাতিকে উদ্ধার করছেন। সংসার নারী-পুরুষ উভয়েরই। সন্তানও উভয়ের। নারীকে দশভুজা, সর্বংসহা ধরিত্রী, প্রকৃতিতুল্য ইত্যাদি গালভরা নামে আখ্যায়িত করলে নারী আর আহ্লাদিত হন না। তিনি চান সমান সমান। তিন বোনের একটা ছোট ভাই। ছোটবেলায় বোনেরা রান্নাবাটি খেললে ভাইটাও বল-বন্দুক ফেলে বোনদের সঙ্গে রান্নাবাটি খেলাতেই অধিক উৎসাহ বোধ করত। মা আতঙ্কিত। ছেলের আবার একি মেয়ে-মেয়ে খেলা! অথচ বড় হয়ে সংসারী হলে সেই ছেলেটির স্ত্রীর মতো সুখী খুব কম মেয়েই হয়েছেন। একটা পরিবারে ছেলে ও মেয়েশিশু পাশাপাশি বড় হলে তারা অভিভাবকদের মানসিকতায় বেড়ে ওঠে। বাবা-মা নিজেদের মধ্যে যেমন আচরণ করেন, শিশুরাও সেটাই শিখে নেয়। মেয়েশিশুটিকে মায়ের মতো নতমুখী মেয়েমানুষ হিসেবে তৈরির যাবতীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। আর ছেলেটিকে বলা হয় বাবার মতো হতে, যে বাবা গটমটিয়ে ময়লা জুতো পরে পরিষ্কার ঘরে বীরদর্পে প্রবেশ করেন, বাইরে পরা জামা-জুতো ইতস্তত ছুড়ে ফেলেন, নানা পদে সাজানো খাবার টেবিলে বসে প্রতিটা পদের খুঁত বের করে চেটেপুটে খান, টিভির রিমোট কন্ট্রোল নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে চায়ের হুকুম চালাতে থাকেন।
বেশির ভাগ পুরুষেরই ধারণা, ঘরের কাজ কোনো কাজই না। যেন ওগুলো রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে নারীরা করে থাকেন। গৃহিণী নারীকেও ‘আপনি কী করেন’ জিজ্ঞাসা করলে তিনি লাজনম্র বদনে ‘আমি কিছু করি না’ বলেন। এ শুনে নারীবাদীরা গোস্যা করেন, বলেন, কী অন্যায় কথা! আরে, আপনি গৃহব্যবস্থাপক। উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন আবার বলছেন কিছু করেন না? কিন্তু যে কাজের বিনিময়ে কোনো অর্থ উপার্জিত হয় না, তাকে তো অর্থনীতির সংজ্ঞায় কাজ বলা যাবে না। নারীর দোষ কোথায়? কেবল গালভরা পদবিতে তাঁর চিড়ে ভিজবে? পুরুষও ভাবেন যে কাজে পয়সা আসে না, তা করে লাভ কী? কিন্তু নারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হচ্ছেন দিন দিন। স্বনির্ভরতা তাঁকে আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাবান করে তুলছে। শুধু বাইরের কাজই নয়, এ ডিজিটাল যুগে ঘরে বসেও নারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। কাজের পরিধি বাড়ছে। এরই সঙ্গে মজ্জায়-মননে জমে থাকা চিরকালীন ধারণা পুষে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ কখনো কখনো অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লেও তা মোটা দাগে খুব সুফল বয়ে আনছে না দেশে-বিদেশে কোনখানেই, বিশেষ করে সন্তানদের জন্য। ঘরের কাজ কোনো অংশেই সামান্য নয়। এ কাজ ভাগাভাগি না করার কারণে যদি সংসার ভাঙে, তার ভার কেন বইবে সন্তানেরা? একটা কুমানসিকতা ভাঙা কি সংসার ভাঙার চেয়েও কঠিন? ছেলেশিশুর হাতে খেলনা পিস্তল তুলে দিয়ে কী পরিণতি হচ্ছে পৃথিবীর, তা প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমই বলে দিচ্ছে। তাই ছেলেশিশুকেও খেলনা-পাতিল দিয়ে ঘরকন্নার কাজ শেখাতে হবে। না হলে কবি আর কত কাল গাইবেন—
‘সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা বেদনার জলাভূমি,
সংসার মানে সংসার ভাঙা সংসার মানে তুমি’।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
muslima.umme@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.