নয়া আতঙ্ক জিকা, সতর্কতা by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও হাসনাইন মেহেদী

বিশ্বজুড়ে এখন নতুন আতঙ্কের নাম জিকা ভাইরাস। মধ্য ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে এ ভাইরাসের সংক্রমণ। এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে ভাইরাসটি প্রতিরোধে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবার্তা দিয়ে জানিয়েছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেউ জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
জিকা ভাইরাস মহামারিতে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে ঘোষণা করা হবে কিনা তা নিয়ে গতকাল জেনেভায় বৈঠকে বসে সংস্থাটি। আলজাজিরার খবরে বলা হয়, বৈঠকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগ দেন আক্রান্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল। বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তা আজ প্রকাশ করার কথা রয়েছে। জিকা ভাইরাস প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে চাপের মুখে রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর আগে সংস্থাটি স্বীকার করে, সাম্প্রতিক ইবোলা মহামারি প্রতিরোধে তাদের পদক্ষেপ যথেষ্ট বেগবান ছিল না।
জিকা ভাইরাস কী: জিকা ভাইরাস ইতিমধ্যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লেও এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই অনেকেরই। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার কামড়ে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে থাকে। এ ভাইরাসের এখনও কোনো প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। এর কোনো চিকিৎসাও নেই। গবেষকরা বলছেন, জিকা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করতে ৩-৫ বছর লাগতে পারে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সামান্য জ্বর, চোখের এক ধরনের প্রদাহ বা মাথাব্যথার মতো লক্ষণ দেখা যেতে পারে। তবে জিকা ভাইরাসের ৮০ শতাংশ সংক্রমণেই কোনো লক্ষণ প্রকাশ না-ও পেতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জিকা ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এতে আক্রান্ত নারীদের প্রসব করা শিশুর মস্তিষ্ক অপুষ্ট ও অবিকশিত অবস্থায় থাকে। জন্ম নেয়া শিশুর মাথার আকারও ছোট হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে এ বিকলাঙ্গতার নাম মাইক্রোসেফালি। ব্রাজিলে এ রোগের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর দেশটিতে অবিকশিত মস্তিষ্কবিশিষ্ট শিশুর জন্মের হার বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ইকুয়েডর, এল সালভাদর, কলম্বিয়া ও জ্যামাইকা নারীদের সন্তান ধারণ বিলম্বিত করার পরামর্শও দিয়েছে। দেশগুলো বলছে, এ ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার আগ পর্যন্ত যেন নারীরা সন্তান ধারণ না করেন।
প্রথম শনাক্ত ২০১৪-এর অক্টোবরে: এখন পর্যন্ত জিকা ভাইরাসে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিল। অক্টোবর মাসে দেশটির উত্তর-পূর্বে অপুষ্ট ও অবিকশিত মস্তিষ্ক নিয়ে শিশুদের জন্ম বেড়ে গেছে বলে লক্ষ্য করা হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মাইক্রোসেফালি আক্রান্তের ২৭০টি ঘটনা নিশ্চিত হওয়া গেছে। সন্দেহের তালিকায় রয়েছে ৩৪৪৮টি ঘটনা। এরপর ধীরে ধীরে সংক্রমণের খবর আসে কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, এল সালভেদর, জামাইকা ও পুয়ের্তো রিকোতে। ব্রাজিলের পর সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে কলম্বিয়াতে। দেশটি জানিয়েছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এদের দুই তৃতীয়াংশই নারী। এছাড়া ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণের ঘটনা। সেখানে ভাইরাসে আক্রান্ত কয়েক ডজন ঘটনা শনাক্ত করা হয়।  
বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ সতর্কতা: জিকা ভাইরাস আতঙ্কে ইতিমধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানও জানিয়েছেন। আমেরিকা অঞ্চলে পুর্তো রিকো দিয়ে শুরু হলেও এখন বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ। ব্রাজিল, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, এল সালভাদরসহ আরও কয়েকটি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্তদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতিতে আমেরিকা অঞ্চলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এছাড়া এসব অঞ্চলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজ নাগরিকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল এবং অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য বিভাগ।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে গর্ভবতী নারীরা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা: এবিএম আব্দুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, ডেঙ্গুর মতোই জিকার লক্ষণ। এটি আসলে এডিস মশার কামড়ে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এখনও এরকম রোগীর কোনো রিপোর্ট হয়নি। এটা যে কোনো বয়সের লোকের হতে পারে। উপসর্গ হলো- জ্বর, ফুসকুড়ি, হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, চোখের প্রদাহ। মায়ের কাছ থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ানোর মাধ্যমে ভাইরাসটি মশা ছড়িয়ে দেয়। রক্তের মাধ্যমেও জিকা ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে এমনটা কম ঘটে। তিনি বলেন, জিকা ভাইরাস অন্যদের জন্য তেমন সিরিয়াস নয়। তবে গর্ভবতী নারীদের জন্য আসলেই আতঙ্কের বিষয়। শিশুদের ‘মাইক্রোসেফালি’ রোগ হওয়ার কারণে মাথা ছোট হয়ে থাকে। এই রোগ হলে শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন ঠিকমতো হয় না। ফলে শিশুর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি অস্বাভাবিক বা বিলম্বিত হওয়া থেকে শুরু করে অকালে মারা যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়? তিনি বলেন, মশা নিধন করার ব্যবস্থা করতে হবে। মশা থেকে বাঁচার জন্য স্প্রে করতে হবে। এটি দিনে কামড়ায়। তাই মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার সময় ফুলপ্যান্ট এবং মোজা পরতে হবে। বিদেশে থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের দিকে নজর রাখতে হবে। লক্ষণগুলো দেখতে হবে। বিশেষ করে যেসব দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের না আসাই ভালো বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভয়ের কারণ নেই। তবে জিকা ভাইরাস নিয়ে টেনশন আছে। জিকা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। ভ্যাকনিশেনও নেই।  তিনি আরও জানান, প্যারাসিটামল, পানি, সরবত খেতে হবে। চিকিৎসা না করলেও ভালো হবে বলে অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, আমাদের এখানে এ ধরনের ঘটনা পাওয়া যায়নি।  সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।

No comments

Powered by Blogger.