১১ বছরে ৬২ হাতি মেরেছে মানুষ by ইফতেখার মাহমুদ

হাতির বিচরণ। টেকনাফের সংরক্ষিত বন
থেকে গত মাসে তোলা ছবি lসুলতান আহমেদ
হাতির সঙ্গে কিন্তু মানুষের বেশ কিছু মিল রয়েছে। মানুষকে বলা হয় সমাজবদ্ধ প্রাণী, হাতিও তাই। হাতি বাঁচে মানুষের মতোই, ৬০ থেকে ৭০ বছর। হস্তিনী মানুষের মতোই সন্তান জন্ম দেওয়া শুরু করে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সে।
মানুষের সঙ্গে এত সব মিল থাকা সত্ত্বেও হাতির সবচেয়ে বড় শত্রু কিন্তু মানুষই। গত ১১ বছরে শুধু বাংলাদেশেই মানুষের হাতে ৬২টি হাতি মারা পড়েছে। এই হিসাব বন বিভাগের। এর আগের হিসাব বন বিভাগের কাছে নেই। তিন বছর ধরে মানুষের হাতে হাতির মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যদিকে হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমছে।
বন বিভাগের হিসাবে, ২০১০ সালে দেশে মানুষের হাতে মারা পড়েছে চারটি হাতি। ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে পাঁচটি করে ও ২০১৪ সালে হাতি মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে সাতটিতে দাঁড়িয়েছে। আর গত সাত মাসে তিনটি হাতিকে মেরে ফেলেছে গ্রামবাসী।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, হাতির বসতি ও চলার পথ দখল করে মানুষ অবকাঠামো গড়ে তুলছে। আর হাতি ওই পথ ধরে এগোলেই বলা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এতে মানুষও মারা যাচ্ছে, হাতিও মরছে। দেশের বৃহত্তম এই প্রাণীটিকে রক্ষা করতে হলে এর চলার পথ বা করিডর ও বসতি রক্ষা করা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হাতি রক্ষায় বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামীকাল বিশ্ব হাতি দিবস পালিত হবে। এবারের হাতি দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘হাতি করলে সংরক্ষণ, রক্ষা পাবে সবুজ বন’। তবে কয়েক বছর ধরে দেশে মানুষের হাতে হাতি মৃত্যুর যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু ওই স্লোগানের উল্টো চিত্রই মনে করিয়ে দেয়।
বন বিভাগ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণবিষয়ক বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) চলমান হাতি জরিপের প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী দেশে বড়জোর ২০০ হাতি রয়েছে। অথচ ২০০৪ সালে আইইউসিএনের জরিপ অনুযায়ী দেশে হাতি ছিল ২৭৯ থেকে ৩২৭টি। এর মধ্যে ১৯৬ থেকে ২২৭টি হাতি বাংলাদেশে আবাসিক বা স্থায়ীভাবে বাস করে। আর বাকিগুলো ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারজুড়ে বিচরণ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় হাতির বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, অভিবাসী হাতিদের কাঁটাতারের বেড়ার কারণে যাতে বিচরণে সমস্যা না হয়, সে জন্য ভারতের বন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আর হাতির করিডর বা বিচরণ পথগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চলাফেরায় হাতি মানুষের চেয়ে স্বাধীন। এরা রাষ্ট্রের সীমানা মানে না। এরা বোঝে কোন বনে তাদের খাবার আছে, চলাফেরার ভালো পরিবেশ আছে। সেই পথ ধরেই এরা চলে, বসবাস করে। স্বভাবের এই প্রাকৃতিক নিয়মও হাতির জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। নির্দিষ্ট পথে চলার এই স্বভাবের কারণে মানুষ এদের সহজে আক্রমণ করতে পারে। অনেকে উন্নয়নের নামে তাদের যাওয়ার পথ বা করিডরে টাঙিয়ে রাখে বিদ্যুতের তার ও ফাঁদ। বিদ্যুতের তারে আটকে গত জুনেই কাপ্তাই এলাকায় তিনটি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানান, হাতিকে কেউ আক্রমণ করলে আত্মরক্ষায় প্রথমে বিশাল শুঁড় উঁচিয়ে চিৎকার করে শত্রুকে বিরত হতে বলে। তারপরেও শত্রু না থামলে কিছুটা সামনে এগিয়ে ভয় দেখায়। তাতেও কাজ না হলে এরা শত্রুকে আক্রমণ করে।
পৃথিবীতে দুই প্রজাতির হাতি দেখতে পাওয়া যায়, একটি এশীয় হাতি, অপরটি আফ্রিকান। এশীয় হাতির বৈজ্ঞানিক নাম Elephas maximus।
বাংলাদেশের মধুপুরগড় থেকে শুরু করে গারো পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপক এলাকার পত্রঝড়া ও চিরসবুজ বনে এক শতাব্দী আগে হাতি বিচরণ করত। এখন এরা শুধু চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার চিরহরিৎ বনাঞ্চলে বিচরণ করে। এদের স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে পাওয়া যায় চুনতি, টেকনাফ, ফাঁসিয়াখালী ও পাবলাখালী অভয়ারণ্য এবং কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, বাঁকখালী, রেজু, ফুলছড়ি, ঈদগড় ও মরিসা এলাকার চিরসবুজ বনাঞ্চলে।
অস্থায়ীভাবে কিছু হাতি মিয়ানমার, ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্য থেকে জামালপুরের ঝিনাইগাতী, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর, সিলেটের কুলাউড়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় নেমে আসে। এরা মাসাধিক কাল বাংলাদেশে থাকে। তবে সাম্প্রতিক কালে শেরপুর ও জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী বনাঞ্চলে ২০-২৫টি হাতি প্রায় সারা বছর বিচরণ করছে।

No comments

Powered by Blogger.