বাতের ব্যথা সারাতে

রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা প্রচলিত সমস্যা। সাধারণত জিনগত এবং পরিবেশগত কারণে এই সমস্যা হয়। আজ ৯ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৩০ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম মতিউর রহমান ভূইয়া।
প্রশ্ন :  রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস, সাধারণ অর্থে বাতের ব্যথা বলে থাকে সবাই। বিষয়টি কী? এই রোগটিতে কী ঘটে এবং কী সমস্যা হয়?

উত্তর :  রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস বা সাধারণত গেঁটে বাতের ব্যথা ১৬ বছর থেকে যেকোনো বছরের লোকের হতে পারে। এতে গাঁট বা জয়েন্ট সাধারণত ফুলে যায়, ব্যথা করে। চিকিৎসা না করা হলে ধীরে ধীরে গাঁটের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। গাঁটগুলো বাঁকা হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। আমরা এটাকে বলতে পারি একটি ক্রনিক রোগ, এটা চলতেই থাকবে। যদি চিকিৎসা না করা হয় তখন বিকলাঙ্গতা তৈরি হতে পারে।
প্রশ্ন : এই ব্যথায় সাধারণত কোন গাঁটে বেশি সমস্যা হতে দেখা যায়?
উত্তর : সাধারণত হাত এবং পায়ের ছোট গাঁটে ব্যথা হতে দেখা যায়। আমরা সাধারণত হাতের কব্জি, ম্যাটাকার্পোফালানজেল গাঁট এবং ইন্টারফালানজেল গাঁট ব্যথা হতে দেখি। তারপর কনুইয়ের গাঁট, কাঁধের গাঁট, ঘাড়ের গাঁট, হাঁটুর গাঁট ইত্যাদি জায়গায় হতে পারে। তবে সাধারণত হাত এবং পায়ের গাঁটে বেশি হয়। এই ছোট্ট গাঁটগুলো ধীরে ধীরে ফুলে যায় এবং অকর্মন্য হয়ে যায়।  মুঠ করতে পারে না। তার দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারে না। এমনকি অনেকে লিখতেও পারে না।
প্রশ্ন : গাঁটের ব্যথা তো আরো অনেক কারণে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটি যে রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসের কারণে হয়েছে সেটি বোঝার উপায় কী?
উত্তর : এটা বোঝার জন্য রোগীর পুরো ইতিহাস নিতে হবে।  কত দিন ধরে ব্যথা হচ্ছে, কোন কোন গাঁটে ব্যথা হয় এবং এটা দুই হাতে হয়েছে কি না, ছোট গাঁটে হয়েছে কি না, এ ছাড়া সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলে আড়ষ্টতা হয়  কি না, ব্যথাটি ছয় সপ্তাহের বেশি ধরে রয়েছে কি না, এগুলো দেখা হয়। যদি ছয় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গাঁট ফুলে থাকে, ব্যথা হয় এবং অন্যকোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে আমরা উনাকে রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসে আক্রান্ত হিসেবে ধরে নিতে পারি। এটা প্রমাণ করার জন্য আমরা কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করি। রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর, এন্টি সিসিপি, ইএসআর , সিআরপি এই কয়েকটি পরীক্ষা সাধারণভাবে করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের এক্স-রে করা যায়। গাঁটের জায়গা ঠিক আছে  কি না , মাঝে মাঝে কোনো গাঁট নষ্ট হয়ে গেলে, এমআরআই, সিটি স্ক্যানের মতো দামি  পরীক্ষাও করা যেতে পারে।
প্রশ্ন : কারা রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ? কাদের বেলায় এটাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে?
উত্তর : সাধারণত রোগটিকে আমরা মাল্টিফ্যাকটোরিয়াল (অনেক কারণে হয় ) বলি। কিছুটা জিনগত কারণে  হয় এবং কিছুটা পরিবেশগত কারণে হয়। জিনগত কারণ ৫০ ভাগ আর পরিবেশগত কারণ ৫০ ভাগ দায়ী। জিনগত কারণের মধ্যে দেখা যাবে ব্যক্তির বাবা-মা, দাদা-দাদি , নানা-নানি তাদেরও এই ধরনের আরথ্রাইটিসের সমস্যা ছিল। এ রকম হলে ব্যক্তির হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ৫০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই এটা পাওয়া যাবে। আর ৫০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় নতুন কিছু ঝুঁকির বিষয় আছে। যেমন বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ। সংক্রমণ সরাসরি করে না, তবে  নাড়িভুড়ির কিছু সংক্রমণ, কিছু শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ (যেমন, ইকো ভাইরাস, ককসাকি ভাইরাস), এমনকি কোনো কোনো দাঁতের সংক্রমণ- এগুলোর ফলে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে শ্বেতরক্তকণিকাগুলো বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত এই শ্বেতকণিকাগুলো গাঁটে সাইনোবিল মেমব্রেনে জমা হয়ে এগুলোকে নষ্ট করে দেয় এবং রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসে পরিণত হয়। তবে সরাসরি সংক্রমণ শরীরে থাকে না, হয়তো সংক্রমণ কোনো সময়ে হয়ে গেছে তার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
এ ছাড়া রয়েছে ধূমপান, এটিও কিছু রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস তৈরি করে। আবার আঘাত, মাঝে মাঝে কোনো কোনো আঘাতের ইতিহাসের ফলে দেখা যায় আরথ্রাইটিস হয়ে গেছে। তবে সরাসরি এগুলোর প্রমাণ পাওয়া যায় না। পরোক্ষভাবে আমরা বলতে পারি, আঘাতও একটি কারণের মধ্যে পড়ে।
প্রশ্ন : অনেকেই চিন্তায় থাকে এই রোগটি পরিপূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব কি না এই নিয়ে। রোগী আপনাদের কাছে এলে কী ধরনের চিকিৎসা করেন?
উত্তর : হ্যাঁ, অনেক রোগী প্রথমেই আমাদের কাছে এটি জানতে চায়। আমরা রোগীকে আশ্বস্ত করি। দেখা যায়, শতকরা পাঁচ থেকে ১০ ভাগ রোগী একদম নিরাময় হয়ে যায়। আর ৯০ ভাগ রোগীর কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করি, যেন সব কাজকর্ম করতে পারে। তাই আমরা বলতে পারি এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এটি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য না হলেও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। হয়তো পাঁচ শতাংশ রোগী অনেক সময় নিরাময়যোগ্য হয়ে যায় কোনো এক অজানা কারণে। এটা সরাসরি বলা যাবে না কারা নিরাময়যোগ্য, আর কারা নয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে কিছু ওষুধ সেবন করা, ব্যায়াম করা, ফিজিও থেরাপি নেওয়া এগুলোর মধ্যে থাকতে হবে। পাশাপাশি রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে।
প্রশ্ন : এই ক্ষেত্রে একজন লোককে যদি দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসার ভেতরে থাকতে হয় তবে চিকিৎসার অংশ হিসেবে আপনারা কী করে থাকেন? পাশাপাশি একটু বলেন,এই ব্যথা যখন দীর্ঘ মেয়াদি হয় তখন কিছু ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে থাকেন। এই ব্যথা নাশক ওষুধ কেউ যদি দীর্ঘদিন সেবন করেন তার বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়- এই ভয়টাও অনেকের মধ্যে কাজ করে। আপনারা কোনো বিষয়গুলো বিবেচনা করে এই ওষুধগুলো দেন?
উত্তর : প্রথমত রোগীকে রোগ সম্বন্ধে আলোচনা করে আমরা বুঝিয়ে দেই। রোগীকে রোগ সম্বন্ধে জানানো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।  আমরা বলি, আপনার এই রোগ কখনো বাড়তে পারে, কখনো কমতে পারে এবং দীর্ঘদিন আপনাকে ওষুধ খেতে হবে। কাজেই ব্যথানাশক যেসব ওষুধ সাধারণত কিডনি, লিভার  বা অন্যান্য অঙ্গপতঙ্গে তেমন ক্ষতি করে না, সেগুলোই আমরা দেই। যখন প্রচণ্ড ব্যথা হবে তখনই খাবে, আর যখন ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যাবে তখন খাবে না। তবে রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কিছু রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা রয়েছে, সালফোনামাইড, লিফ্রোনামাইড, সালফাস্যালাজিন এগুলো আমরা সাধারণত তাদের নিয়মিত সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকি।
আর ব্যথার ওষুধ যখন ব্যথা বেশি থাকবে তখন খাবে আর ব্যথা যখন কমে যাবে তখন খাওয়া বন্ধ করে দেবে। এর মধ্যে কম সমস্যা হবে এমন ওষুধ অনেক আছে। এমনকি কিডনির কোনো ক্ষতি করবে না এ রকম ব্যথার ওষুধও আছে। আমরা সাধারণত সেগুলোই চিকিৎসাপত্রে দিয়ে থাকি।
আর যেগুলো কিছু ক্ষতি করে সেগুলো আমরা যখন রোগীকে দেই তখনো রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে লিভার, কিডনি এবং রক্তের কতগুলো পরীক্ষা নিয়ে আসতে বলি যেন এগুলোর কোনো সমস্যা হলে আমরা আগে থেকেই ধরতে পারি।
প্রশ্ন : একজন রোগী এভাবে দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং তার মধ্যে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না- এটা আপনারা দেখলেন। সে নিয়মি ওষুধ খাচ্ছে, চিকিৎসকের ফলোআপে থাকছে। এর পাশাপাশি সেই রোগীর জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তনের বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর :  তার খাবারদাবার, ব্যায়ামে অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা সবাইকেই পরিমিত খাবার, পরিমিত ওজনের কথা বলি। এমনকি শাকসবজি বেশি খাওয়া এসব বিষয়ে উৎসাহিত করি। আর মাছ মাংস যতটুকু প্রয়োজন তার ততটুকু যেন খান। ওজন যেন বেশি না হয় এবং বেশি ওজন থাকলে যেন কমান, স্বাভাবিক ওজনে ফিরে আসতে পারেন- এটা অবশ্যই দরকার। সঙ্গে সঙ্গে ফিজিওথেরাপি, জীবন যাপনের ধরনের পরিবর্তন অত্যন্ত দরকার। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করা, বিভিন্ন পেশিতে, গাঁটে ব্যায়ম করা। একটু ফিজিওথেরাপিস্টের  পরার্মশ নিতে হবে। কোনো কোনো গাঁটের জন্য ফিজিওথেরাপির দরকার হতে পারে। আবার কোনো কোনো গাঁটের জন্য ইনজেকশনের দরকার হতে পারে। আর যেসব ওষুধ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা সেগুলো নিয়মিত খেয়ে যেতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.