সেকালের রাজনৈতিক নেতাদের গল্প by সৈয়দ আবুল মকসুদ

উপমহাদেশের রাজনীতি তখন অতি উত্তপ্ত। ব্রিটিশ শাসকদের থেকে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অল্প আগে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক। দুই পক্ষে চলছে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, তবে তা অশালীন ও ইতর ভাষায় নয়। মহাত্মা গান্ধী ও কায়েদে আজম জিন্নাহ দুই দলের শীর্ষ নেতা। শেষ মুহূর্তে একটা সুরাহা করা যায় কি না, তার জন্য দুই নেতাকে একত্রে বসার তাগিদ সবার। গান্ধীজি সব সময়ই রাজি ছিলেন, জিন্নাহ শেষমেশ সম্মত হন। জিন্নাহ পায়ে চোট পেয়েছিলেন হোঁচট খেয়ে, বললেন, আমি গান্ধীর ওখানে যেতে পারব না। (প্রকৃতপক্ষে ফরাসে স্যুট পরে বসার ভয়ে তিনি যাননি, অথবা গান্ধীর কাছে তিনি যাবেন না।) গান্ধী বললেন, আমিই যাব তাঁর বাড়িতে। এবং গেলেন। পোর্চে এসে পাশ্চাত্য কায়দায় গান্ধীজিকে অভ্যর্থনা জানান জিন্নাহ।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দুই নেতা চেয়ারে বসলেন খুব কাছাকাছি কিন্তু কোনাকুনি। সাহেবদের মতো চেয়ারে বসে বিশেষ স্বস্তিবোধ করতেন না গান্ধীজি। যা হোক, গান্ধীজি প্রথমেই জিগ্যেস করলেন, কায়েদে আজম, আপনার পায়ের অবস্থা কী?
গান্ধী বয়সে বড়। জিন্নাহর চেয়ে বড় নেতা শুধু নন, মহান মানুষ। জিন্নাহ বললেন, ব্যথা এখনো আছে। গান্ধী বললেন, কোথায়? জিন্নাহ তাঁর নিপাট ইস্তিরি করা প্যান্ট একটু তুলে দেখালেন, গোড়ালির কিছু ওপরে।
চেয়ার থেকে নেমে গান্ধী জিন্নাহর মাংসবিহীন পায়ের ব্যথার জায়গাটায় হাত বুলিয়ে কিছু টোটকা ওষুধ বাতলালেন। গান্ধীজির মতো মানুষ তাঁর পায়ে হাত বোলানোতে কঠিন-হৃদয় জিন্নাহ প্রতিপক্ষ নেতার প্রতি শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে থাকবেন। যদিও তিনি তাঁর নীতি-আদর্শের প্রশ্নে আপস করেননি।
অনেকেই জানেন না গান্ধীজি একজন ভালো প্রাকৃতিক চিকিৎসক ছিলেন। নিজের ও অন্যের চিকিৎসা করতেন প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে, গাছগাছড়ার পাতা ও ছালের রস খাইয়ে বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে। গান্ধীবাদীদের আলাদা চিকিৎসাব্যবস্থা আছে। গান্ধী প্রাকৃতিক চিকিৎসাকেন্দ্র দিল্লি থেকে আমি সপ্তাহ খানেকের সবক নিয়েছিলাম। ওই পদ্ধতির চিকিৎসায় মোটামুটি ভালো থাকি। তবে জিন্নাহর গান্ধীর ডাক্তারিতে বিশ্বাস ছিল না। বড় বড় ডাক্তার তাঁর পায়ের ব্যথা দূর করে বর্তে গিয়েছিলেন। উভয়েই গুজরাটি হওয়ায় গান্ধীজি কথা বলেছিলেন মাতৃভাষায়, জিন্নাহ ইংরেজিতে বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। গান্ধীর ওষুধের ব্যবস্থায় থ্যাংকস দিয়েছিলেন।
সেই এক সময় ছিল, যখন সম্ভ্রান্ত ঘরের সত্যিকারের সুশিক্ষিত মানুষেরাই রাজনীতি করতেন। ইতর প্রকৃতির, অর্ধশিক্ষিত, ছোটলোকেরা (বিত্তহীন হলেই বা নিরক্ষর হলেও একজন ছোটলোক হয় না।) তখন রাজনীতির আসরে স্থান পেতেন না। সেকালে কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেন না কেউ। যত কট্টর প্রতিপক্ষই হোক, সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বলতেন। কংগ্রেস ও লীগের নেতাদের নীতি-আদর্শ যা-ই হোক, তাঁরা বড় ঘরের সন্তান ছিলেন বলে তাঁদের ভাষা ছিল সংযত।
১৯৩০ দশকের শেষ দিকে সুভাষচন্দ্র বসু শুধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতা নন, সমগ্র ভারতের জনপ্রিয় নেতা। ১৯৩৮-এ হরিপুরা অধিবেশনে নেতাজি সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেসের সভাপতি হন। সেকালে ১০০ বছর কেউ দলের সভাপতির পদ আঁকড়ে থাকতেন না। প্রতিবছর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন হতো। ১৯৩৯-এ ত্রিপুরি কংগ্রেসে গান্ধীজির সমর্থিত দক্ষিণপন্থী জোটের প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে নেতাজি সভাপতি পুনর্নির্বাচিত হন। বাংলার যুবসমাজ গান্ধীজির ওপর খুবই ক্ষিপ্ত। এর মধ্যে গান্ধীজি কলকাতা ও পূর্ববঙ্গে সফরে আসার ঘোষণা দেন। তাঁকে প্রতিহত করার ডাক দেয় কংগ্রেসের সুভাষপন্থী তরুণসমাজ। গান্ধীপন্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। তারা হাওড়া স্টেশনে গান্ধীকে নামতেই দেবেন না। নেতাজি পত্রিকায় একটি বিবৃতি দিয়ে তাঁর অনুসারীদের সংযত থাকতে অনুরোধ করেন। অনুসারীদের বলেন, বাংলায় মহাত্মার অমর্যাদা হলে তা হবে আমারও অমর্যাদা। তার পরেও স্টেশনে কিছু গোলযোগ হয়েছিল। তার জন্য নেতাজি দায়ী নন। সুভাষ বসুর প্রতি গান্ধীজি সুবিচার করেননি, কিন্তু সেই সুভাষই তাঁকে ‘ভারতের জাতির জনক’ বলে প্রথম সম্বোধন করেন। সেই থেকে ‘জাতির জনক’ কথাটি উপমহাদেশের তিন দেশেই প্রচলিত হয়। ‘জাতির জনক’ কথাটির জনক নেতাজি সুভাষচন্দ্র।
ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে জেনারেল কারিয়াপ্পা ও জেনারেল আইয়ুব খান একত্রে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর ভারত-পাকিস্তান প্রথম যুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন জেনারেল কারিয়াপ্পা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল আইয়ুব। সেই যুদ্ধের সময় থেকে দুই দেশ পরস্পর শত্রু। আইয়ুবের সিনিয়র ছিলেন কারিয়াপ্পা। আইয়ুব তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব চমৎকার। সম্ভবত ১৯৬৩ বা ’৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব জেনারেল কারিয়াপ্পাকে পাকিস্তান সফরে আমন্ত্রণ জানান। ভারতীয় জেনারেল বলেন, তিনি চট্টগ্রামে কয়েকটি দিন কাটাতে চান। আইয়ুব বলেন, আলবত। রাওয়ালপিণ্ডি থেকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয় জেনারেল কারিয়াপ্পাকে সর্বোচ্চ আতিথেয়তা দিতে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের এক জেনারেলকে বলা হয়, কারিয়াপ্পা চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা পছন্দ করেন না। তাঁর জন্য জোগাড় করো ফরাসি দেশের সবচেয়ে দামি মদ। আইয়ুবের হুকুমে তখন বাঘের চোখ পর্যন্ত জোগাড় করা সম্ভব। জেলা প্রশাসক সুরার কার্টনটি নিজের হাতে জেনারেলের কামরায় তাঁর টেবিলের ওপর রেখে আসেন। পানপাত্র ও ফ্রিজে পর্যাপ্ত বরফ।
চট্টলায় এত দর্শনীয় জায়গা থাকতে জেনারেল কারিয়াপ্পা বললেন, ডিসি সাহেব, আমাকে আপনাদের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়টা দেখাতে পারেন কি না। তাজ্জবের কথা! এত কিছু থাকতে খাস্তগীর বালিকায় কেন? তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হায়, হৃদয় খুঁড়ে স্মৃতি বা বেদনা জাগাতে কে না ভালোবাসে? বিষয়টি নিয়ে আমি পরে বিস্তারিত লিখব। দক্ষিণ এশিয়ার যে জাঁদরেল জেনারেল পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করেন, তাঁকে পরাজিত করেছিল সুদূর অতীতের কোনো এক সময় খাস্তগীরের কারও ডাগর চোখ।
পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বর যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপার জেনারেল কারিয়াপ্পার ছেলে ক্যাপ্টেন কারিয়াপ্পা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। কীভাবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কানে যায় সে খবর। আইয়ুব বলেন, অন্য বন্দীদের সঙ্গে ওকে তো তোমরা জেলে ঢোকাতে পারো না। আমার বন্ধুর ছেলে। মাথার পাতলা চুল চুলকে প্রেসিডেন্ট বলেন, ওকে বরং রাষ্ট্রপতি ভবনে নিয়ে এসো। এখানেই সাবজেল বানিয়ে রাখো কয়েক দিন, ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত। সে আমার অতিথি। ছেলের মতো।
আইয়ুব অভিজাত পরিবারের মানুষ ছিলেন না। একজন রিসালদারের ছেলে। আলীগড়ে পড়ালেখা করেছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ব্রিটিশ রাজকীয় সেনাবাহিনীতে। সৌজন্য, ভদ্রতা কাকে বলে তা জানতেন। ছিলেন সামরিক একনায়ক, কিন্তু দক্ষ প্রশাসক। পুরো ষাটের দশকে আমরা রাজপথে স্লোগান দিয়েছি তাঁর রাজত্বের ধ্বংস কামনা করে। যেসব নেতার পেছনে থেকে স্লোগান দিয়েছি, তাঁদের কেউ কেউ এখন মন্ত্রী।
আইয়ুব পাকিস্তানে গণতন্ত্র হত্যা করেন। তাঁর আমলে পাকিস্তানের দুই অংশের গণতান্ত্রিক নেতা ও বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনপন্থী নেতাদের তিনি জেলখানার আতিথেয়তা দিয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান এবং আইনমন্ত্রী এস এম জাফরদের প্ররোচনায় শেখ মুজিবকে নানাভাবে ফাঁসানোর ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এখন অনেকের বিশ্বাস হবে না যে সেই আইয়ুবই আগরতলা মামলা তুলে নেওয়ার পর ইসলামাবাদে তাঁর রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে বঙ্গবন্ধুকে একাকী আমন্ত্রণ করে একত্রে নৈশভোজ করেন। সেদিন খ্যাতিমান তথ্যসচিব আলতাফ গওহর কী কাজের অজুহাতে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কাছে থেকে তাঁদের কথাবার্তা শুনবেন। আইয়ুব বলেন, আপনার এখানে থাকার দরকার নেই। চলে যান। গণদাবির কারণে কয়েক দিন পরেই আইয়ুব পদত্যাগ করেন। অনুমান করি, সেদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে অতীতে বৈরী আচরণ করার জন্য।
রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ থাকবেই। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে মতৈক্য থাকলে ভারতবর্ষ ভাগ হতো না। একমাত্র মহাত্মা গান্ধী ছাড়া দুই দলের সব নেতাই ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু। হিজ ম্যাজেস্ট্রি ব্রিটিশরাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঘোষণা দিয়েছেন ১৪-১৫ আগস্ট মধ্যরাতে দুই দলের নেতাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, যে ক্ষমতা ১৯০ বছর আগে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত ও হত্যা করে এবং বাহাদুর শাহ জাফরকে মিয়ানমারে নির্বাসন দিয়ে। দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে তিক্ততা চরমে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন যিনি, সেই নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের মাতৃভূমি মধ্যপ্রদেশ। চিরদিনের জন্য তিনি স্বদেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন। যাওয়ার দুই দিন আগে সম্ভবত ১২ আগস্ট রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নবাবজাদাকে তাঁর বাড়িতে খেতে ডাকেন। প্রেসকে জানানো হয়নি। চুপচাপ খাওয়া-দাওয়া করে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিদায় জানান।
সেকালের রাজনীতিকেরা ছিলেন অন্য রকম। কল্পনাও করা যায় না যে গান্ধী জিন্নাহকে উদ্দেশ করে বলছেন, হাঁটু থিকা পাও ভাইঙ্গা ইয়া কইরা দিমু। কিংবা ভারত ভাগের সময় নেহরু লিয়াকতকে বলছেন, আর কোনো দিন ভারতের মাটিতে আইলে ঘাড় ধইরা বাইর কইরা দিমু। অথবা আইয়ুব কারিয়াপ্পার ছেলেকে গ্রেপ্তারের কথা শুনে বলছেন, বাপের মতোই শয়তান অইছে, ওই বাছুরডারে হাজতে ঢুকাইয়া উত্তম-মধ্যম দ্যাও। তা ছাড়া মাথা ফাটিয়ে দিলেও কেউ কারও জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন না। এসব প্রসঙ্গে কথা অমার্জনীয় ও জঘন্য অপরাধ। কোনো নারী, তা তিনি কোনো নগরের মেয়রই হোন বা যিনিই হোন, তাঁকে টিভি টক শোতে কোটি কোটি দর্শকের সামনে তুই তোকারি করা বা তাঁর দিকে ঘুষি পাকিয়ে ধেয়ে যাওয়া খুবই বর্বর দৃশ্য।
বহুদলীয় গণতন্ত্রে নেতারা প্রতিপক্ষের সমালোচনা করবেন, আক্রমণ করবেন রাজনীতির ভাষায়। শত্রুকে নিন্দা করারও একটা ভাষা আছে, মাত্রা আছে; তা অতিক্রম করলে যিনি করেন তা তাঁর গায়েই এসে পড়ে, যাঁর উদ্দেশে করা হয় তাঁর কোনোই ক্ষতি হয় না, বরং উপকার হয়। তাঁর প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়ে।
সেকালের নেতাদের ব্যর্থতা এখানে যে তাঁরা আমাদের আদব-কায়দা, সৌজন্য, ভদ্রতা ও ঔচিত্যবোধ কিছুই শিখিয়ে দিয়ে যাননি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.