নিয়োগপর্বেই ওএসডি by আলী ইমাম মজুমদার

বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ইংরেজি প্রতিশব্দ অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি। এর সংক্ষিপ্ত রূপ ওএসডি শব্দটি বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গনে বহুলভাবে ব্যবহৃত। তবে বাস্তব অর্থে এ শব্দটি পদের কর্মপরিধির সঙ্গে সংগতিহীন। কেননা, এই বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ বিশেষ কেন, সাধারণত কোনো দায়িত্বই পালন করেন না। বহন করেন না কোনো ভার। তাঁরা মাঝেমধ্যে অফিসে ঢুঁ মারেন। নেই তাঁদের কোনো অফিস কিংবা চেয়ার-টেবিল। তবে রয়েছে বেতন-ভাতাদি। প্রাধিকার অনুসারে বাড়ি-গাড়িও।

তবু ওএসডি করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক প্রয়োজনে যেমন, দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ছুটিকালে। পদোন্নতিকালেও কিছু কর্মকর্তাকে পদায়নের আগে সাময়িকভাবে ওএসডি করার আবশ্যকতা থাকে। এগুলো করা হয় বেতন-ভাতাদি দেওয়ার সুবিধার্থে। তবে হাল আমলের পদোন্নতিতে তা-ও আবশ্যক হয় না। এখন পদ উন্নীত হলেও প্রায় ক্ষেত্রে কর্মকর্তার কার্যক্ষেত্রের আওতা একই থেকে যাচ্ছে। আবার শৃঙ্খলামূলক কোনো কার্যক্রম চলাকালেও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ক্ষেত্রবিশেষে ওএসডি করা হয়ে থাকে। এসব ছাড়াও কর্তৃপক্ষের অপছন্দের কর্মকর্তাও ওএসডি হন প্রায়ই।
গত দুই যুগ তাঁদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। কেউ কেউ ওএসডি থাকেন বছরের পর বছর। তাঁদের গুটি কয়েক সৃজনশীল কিছু কাজ নিয়ে থাকলেও বেশির ভাগই করেন অকর্মণ্য জীবনযাপন। কারও বা এভাবেই অবসরের সময় চলে আসে। এ ধরনের ওএসডি করার প্রবণতা পাকিস্তান সময়কালেও দু-একটি ছিল বলে জানা যায়। লাহোর হাইকোর্টের এককালীন খ্যাতিমান প্রধান বিচারপতি কায়ানি চাকরিজীবনের শুরুতে আইসিএস ছিলেন। তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন একজন সিএসপি কর্মকর্তাকে এ ধরনের ওএসডি করা সম্পর্কে ক্ষোভ মিশ্রিত রসিকতা করে এক ভাষণে বলেছিলেন, ওএসডি প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে ডিডিটির মতো। এটা মনের জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। এরা সিএসপি-কুলের উৎকৃষ্ট শ্রেণি। এখানে কোনো কাজ না করেই পুরো বেতন পাওয়া যায়। তবে হাল আমলে এর মাত্রা আর আঙ্গিকে এ ধরনের রসিকতার সুযোগ চলে গেছে। কেননা, মানুষ অল্প শোকে কাতর হলেও অধিক শোকে হয়ে যায় পাথর।
প্রচলিত ধরনের ওএসডি-পর্ব প্রসঙ্গ আলোচনা অনেক হয়েছে। তবে চাকরির শুরুতেই ওএসডি করা সম্ভবত আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে একেবারেই নতুন সংযোজন। যাঁরা এটা করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা নতুন ধারা প্রবর্তনের জন্য ‘স্মরণীয়’ থাকবেন। ‘পথিকৃৎ’ বিবেচিত হবেন ওএসডি হয়ে যাঁরা নতুন চাকরিতে যোগ দিলেন, তাঁরাও। খবরে প্রকাশ, সরকারের অনুমোদিত পদের চেয়ে এক হাজার ৬৪৭ জন চিকিৎসককে ওএসডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের ‘কর্মস্থল’ নির্ধারিত হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোয়। তাঁদের জন্য এখনই বছরে ব্যয় হবে ৩৫ কোটি টাকা। তাঁরা অতিসম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া ছয় হাজার ২২১ জন চিকিৎসকেরই অংশ।
চিকিৎসকদের চাহিদা আমাদের আছে রাজধানী থেকে পল্লি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত। সে হিসাব করেই শূন্য পদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো ক্যাডারে প্রকৃত চাহিদার অনধিক ১০ শতাংশ অতিরিক্ত রাখা হয় প্রশিক্ষণ, ছুটি ও প্রেষণজনিত কারণে। দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ছুটিতে থাকা কর্মকর্তারা ওএসডি হন। তবে ওএসডি হিসেবে নিযুক্তি দিয়ে রাজধানী ও এর আশপাশের অঞ্চলে সংযুক্ত করা একটি নজিরবিহীন অরাজক অবস্থা বললে অত্যুক্তি হবে না। নিয়োগের পরপর গণমাধ্যম মোকাবিলায় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সংখ্যাধিক্য নিয়োগের জন্য একে অন্যকে দায়ী করেছে। তবে বিএমএ মহাসচিব যথার্থই বলেছেন যে এ পদায়নের কারণে সরকার ও চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট সবাই বিব্রত।
শেষাবধি এসে মন্ত্রণালয় দিচ্ছে আরও একটি বিস্ময়কর যুক্তি। তাদের মতে, ২৫ হাজার সদস্যের ক্যাডারে দুই হাজার ৫০০ ওএসডি থাকতে পারেন। কিন্তু ওএসডি থাকার কথা তো শুধু দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ছুটিকালে কিংবা কোনো শৃঙ্খলাজনিত কারণে। আর তা-ও নির্ধারিত পদসংখ্যার মধ্যে। নিয়োগকালে অতিরিক্ত নিয়োগ দিয়ে অবশ্যই নয়। তবু মন্ত্রণালয় আশা করছে, এই ওএসডি চিকিৎসকেরা পল্লি অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা দেবেন। নিয়মিত পদাধিকারীদের থেকে যা পাওয়া যায় না, তা ওএসডি পদধারীদের কাছে আশা করা হচ্ছে। আশাবাদ ভালো। তবে তা যৌক্তিক হওয়ার কথা নয় কি?
আমাদের স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক উপজেলা থেকে পল্লি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। এসব স্থানে চিকিৎসকের পদও রয়েছে। সে পদের হিসাব ধরেই নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব স্থানে নিয়োগকৃত চিকিৎসকেরা সূচনা থেকেই ঢাকা কিংবা বড় শহরে বদলির অবিরাম চেষ্টা চালাতে থাকেন। আর তাঁদের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ অবস্থান করে কর্মস্থলে। এরূপ রাশি রাশি খবর পত্রপত্রিকায় আসছে সময়ে সময়ে। অবশিষ্ট অংশ শুধু বেতন নেওয়ার প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে করে যাওয়া-আসা। এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনতে মহাজোট সরকারের গত মেয়াদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। কর্মস্থলে অনুপস্থিতির জন্য বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজনকে সাসপেন্ডও করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা রয়েছে অপরিবর্তিত। এমনকি এবারের এত বেশি নিয়োগের পরেও তেমন কিছু উন্নতি হবে, এ দুরাশা অনেকেই করেন না।
স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক যতই সম্প্রসারিত হোক, প্রত্যন্ত পল্লির জনগণ চিকিৎসকদের খুব কম অংশের সেবাই পেয়ে থাকেন। মফস্বলে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকেরা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রেষণ, সংযুক্তি—ইত্যাদির নামে ঢাকার নামীদামি সরকারি হাসপাতালে চলে আসেন। মাত্র কয়েক মাস আগে একটি পরিসংখ্যান বেরিয়েছিল চিকিৎসকদের কর্মস্থল সম্পর্কে। রাজধানীর বড় হাসপাতালগুলোয় নির্ধারিত পদের দ্বিগুণ বা তারও বেশি ‘কর্মরত’ রয়েছেন। এখানেও কি আমরা তাঁদের সত্যিকার সেবা নিতে পারছি? আর জেলা সদরের নিচে হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো চিকিৎসক-সংকটে থাকে। কোথাও নিযুক্তিই নেই আর কোথাও বা কাজির গরুর মতো শুধু কেতাবে আছে। স্মরণ করা যায়, একসময় এ ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো জেলা বোর্ডের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। এলএমএফ চিকিৎসকেরা সেখানে ছিলেন। ছিল তদারকি। তাই তাঁদের কর্মস্থলকে অবজ্ঞার সুযোগ ছিল না।
ওএসডি হিসেবে নিয়োগ নিয়ে কোনো কোনো পত্রিকা খবর করেছে, তদবিরের চাপে এই ওএসডি নাটক। হতেও পারে। তদবির হয়, এটা সত্য। তাই পদায়নের দায়িত্বটা যাঁদের ওপর, তাঁরা চাপের মুখে থাকেন। কিন্তু এর মাত্রা কি এমন পর্যায়ে যেতে পারে? ঢাকা কিংবা এর কাছাকাছি রাখার জন্য এক হাজার ৬৪৭ জন নবনিযুক্ত চিকিৎসককে ওএসডি করে পদায়ন করতে হবে? ধারাবাহিকভাবে আমাদের সরকারগুলো স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে উদার উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে চিকিৎসকদের মফস্বলে থাকার চরম অনীহা এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তা ছাড়া রাজধানীসহ বড় বড় শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মানও ক্রম নিম্নমুখী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা নিজস্ব চেম্বার ব্যবসার স্বার্থে উপেক্ষা করছেন তাঁদের মৌলিক দায়িত্ব। ফলে চুটিয়ে ব্যবসা করছে বেসরকারি হাসপাতাল। বিত্তবানেরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে। বেসরকারি হাসপাতালও তাঁদেরই আওতায়। নিম্নবিত্ত কেন, মধ্যবিত্তশ্রেণির জন্যও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নেওয়া দুরূহ। আর সমাজের ভাগ্যবঞ্চিত হতদরিদ্রশ্রেণি কার্যকর চিকিৎসাসেবার বাইরেই থাকছে। কেউ বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভিটেবাড়ি বিক্রি করেও চিকিৎসাসেবা নেয়। সরকারি বড় হাসপাতালে এ ধরনের রোগী এলে থাকে উপেক্ষিত। ফলে দালালের খপ্পরে পড়ে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে আর্থিকভাবে হয় বিপন্ন। দালালদের এ ধরনের ফাঁদ পাতাই থাকে সরকারি হাসপাতালের ভেতর ও বাইরে। আর এমনটা কীভাবে এবং কেন ঘটে, তা সহজেই অনুমেয়।
যত সমালোচনাই করা হোক, চিকিৎসকেরা সমাজের অতি প্রয়োজনীয় একটি অংশ। যথেষ্ট মেধাবী ছাত্ররাই কঠোর পরিশ্রম করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিগ্রি নেন। আমাদের সবারই প্রয়োজন আছে তাঁদের কাছে। তাঁদের অনেকেই আমাদের অতি আপনজন। প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসকদের প্রতি শ্রেণি হিসেবে কোনো বৈরিতা কারও নেই। থাকতে পারে বিশেষ কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। চিকিৎসকদের জীবনধারণ ও কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য আবশ্যক হলে সরকারের সামর্থ্যের মধ্যে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করা সংগত। পাশাপাশি তাঁরা সম্ভাব্য ভালো মানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করবেন, এ প্রত্যাশাও যৌক্তিক। আজকাল শিক্ষিত বেশ কিছু লোক থাকছেন উপজেলা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ হাটবাজারের কাছাকাছি। সেখানে অন্য সরকারি কর্মকর্তারাও থাকেন। এসব স্থানে চাকরি করতে চিকিৎসকদের অনীহা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আরও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না নিয়োগপর্বেই এক হাজার ৬৪৭ জন চিকিৎসককে ওএসডি হিসেবে পদায়ন।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.