শান্তি, সমৃদ্ধি ও মৈত্রীর সন্ধানে চীন

পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ফর ফ্রেন্ডশিপ
অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং
গত মে মাসের মাঝামাঝিতে চীনা কর্তৃপক্ষ একটি সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের লক্ষ্য ছিল, চীনের পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ফর ফ্রেন্ডশিপ উইথ ফরেন কান্ট্রিসের ষষ্ঠ দশক পূর্তি উদ্‌যাপন করা। প্রতিটি দশক পূর্তিতে এই সংস্থাটি এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এই বছরের এই উদ্‌যাপন উৎসবে বিশ্বের প্রায় ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল। সম্মেলনে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনওয়ারুল আমিন আর আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আনওয়ারুল আমিন প্রায় সাত বছর একজন ব্যাংকার হিসেবে চীনে অবস্থান করেন এবং তার পর থেকেই চীন বাংলাদেশ মৈত্রীর উন্নয়নে পরিশ্রম করছেন। আমার ৩৬ বছরের কর্মজীবনের একটি বিরাট অংশ কেটেছে চীনে এবং চীন-সম্পর্কিত বিষয়াদিতে৷ সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বকে প্রসারতর করার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছি। তাই আমরা দুজনই এই আমন্ত্রণটি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম। বিদেশি প্রতিনিধিদের মধ্যে ভারতীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা একটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিল ইতিহাসখ্যাত ভারতীয় চিকিৎ​সক কুটনিসের পরিবারের অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের ছয়জন সদস্য। তাঁদের মধ্যে একজন ডা. কুটনিসের ভাতিজা, ৯১ বছর বয়সে আমাকে বয়োজ্যেষ্ঠতার প্রতিযোগিতায় অনায়াসে পরাজিত করেন। শুধু তা-ই নয়। চীনের ‘গ্রেট হল অব ফি পিপলসের’ সুদীর্ঘ বারান্দা ও করিডর অতিক্রম করতে তাঁর জন্য রক্ষিত হুইলচেয়ারটি আমার সুবিধার্থে আমার জন্য ছেড়ে দেন! বয়স্ক পাঠকদের কাছে ভারতীয় চিকিৎ​সক কুটনিস সুপরিচিত হওয়ার কথা। চীন-জাপান যুদ্ধে তিনি চীনের পক্ষে বিশেষ অবদান রাখেন এবং চীনাদের সেবারত অবস্থায় সেখানেই চল্লিশের দশকে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর জীবনের ওপর ভি. শান্তারাম ডা. কুটনিসকি অমর কাহানি শীর্ষক একটি জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। অতএব ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন কুটনিস পরিবারেরই ছয়জন সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নাতি, ক্রিস্টোফার কক্স নিক্সন। বলাই বাহুল্য যে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কোন্নয়নে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিশাল অবদানের স্বীকৃতি ছিল অনুষ্ঠানটিতে তাঁর নাতির উপস্থিতি। এই সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, তাঁর অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ১৫ মিনিটের ভাষণ। ২০১৪ সালের ১৫ মে এই ভাষণটি এই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বসম্পর্ক, বিশ্বশান্তি ও চীনের উন্নয়ন নিয়ে চীনের বর্তমান চিন্তাধারা তাতে প্রতিফলিত হয়েছে। চীনের নেতাদের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে, শব্দের বিন্যাস এবং চয়ন কোনো বিষয় তুলে ধরতে উপমার প্রয়োগ এবং ভাবনার অলংকরণ চিত্তাকর্ষক। এই ভাষণটি তার ব্যতিক্রম ছিল না। চীনের দুই হাজার বছরের দার্শনিক গুরু কনফুসিয়াসের (যদিও ষাট ও সত্তরের দশকের কট্টর কমিউনিস্ট শাসনের সময়ে তাঁর নাম উচ্চারিত হতো না) উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু হয় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভাষণ। দুই হাজার বছর আগে কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘সুদূরের বন্ধুদের আগমন সদাই আনন্দদায়ক।’ এই কথাটি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্মরণ করলেন। তারপর বললেন, ‘জাতি হিসেবে চীন একফোঁটা পরিমাণ পানির দয়ারও প্রতিদান দিতে চায় কৃতজ্ঞতার ঝরনাধারায়। চীনারা তাদের বন্ধুদের কখনো ভুলবে না।’ তিনি কৃতজ্ঞতা জানালেন সেসব আন্তর্জাতিক বন্ধুকে, যারা চীনের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বের মূল্য প্রদানে চীনের বিপ্লব, সংস্কার আর উন্নয়নের প্রতি সহানুভূতি এবং সমর্থন জানিয়েছে৷’ তিনি বললেন, ‘বিশ্বাস ও সমতাই হচ্ছে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্কের পূর্বশর্ত।’ তাঁর কথায় আমরা যতই ‘বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব, অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ও তথ্যবিপ্লবের প্রয়োগের পানে ধাবিত হচ্ছি; জাতীয় স্বার্থ, ভাগ্য ও নিরাপত্তার নিরিখে পৃথিবীর দেশগুলো পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা এবং একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
তারা আজ সম্মিলিত ভাগ্যোন্নয়নে একটি সুসংঘবদ্ধ পরিবারের সদস্য’। চীনের কথা বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বললেন, চীন এখন ‘উন্নয়ন সংস্কার ও প্রগতির’ সংগ্রামে লিপ্ত। চীনের শতাব্দীর লক্ষ্য দুটি—যথা একটি উন্নয়নশীল সমাজ নির্মাণের সম্পূর্ণকরণ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ২০১০ সালের তুলনায় চীনের শহর ও গ্রামাঞ্চলে মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করা৷ এভাবেই চীন এই শতাব্দীর মাঝামাঝিতে একটি আধুনিক সমাজবাদী দেশে পরিণত হবে; যা বিত্তশীল, ক্ষমতাবান, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আগুয়ান দেশ হিসেবে চীনের জাতীয় নবায়নের স্বপ্ন সার্থক করবে। এই স্বপ্ন শুধু চীনাদের নয়, অন্যান্য দেশের মানুষের স্বপ্নেরই প্রতিফলন। তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়নে চীন তাদের হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে। চীনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন পৃথিবীতে একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। শি জিনপিং বলেন, ‘শত শত নদনদী বরণ করেই সাগর বিশাল আকার ধারণ করে।’ চীন নিজেকে বহির্বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করবে, পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে এবং ‘সিল্ক রোডের’ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং একবিংশ শতাব্দীর জলপথের ‘সিল্ক রোডের’ উন্নয়ন করবে, যাতে দেশগুলো তাদের উন্নয়ন সম্ভাবনা ভাগ করে নিতে পারে। অধিকতর উন্মুক্ততা নিয়ে চীন সাংস্কৃতিক দেওয়া-নেওয়া করবে, যাতে বিশ্বসভ্যতা পারস্পরিক শিক্ষালাভের ভিত্তিতে এগিয়ে যায়। তারপর শি জিনপিংয়ের কথা হলো চীনের সাম্প্রতিক দ্রুত অগ্রগতিতে কিছু মানুষ চীনের আধিপত্য বিস্তারের ভীতি পোষণ করছেন। তাঁদের এই মনোভাব ভ্রান্ত ধারণা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীনের প্রতি বিরূপ মনোভাবেরই প্রতিফলন। কিন্তু চীন মনে করে, শান্তি হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান এবং অন্যদের প্রতি প্রীতি ও বন্ধুত্ব প্রদর্শন করা এবং ‘কারও বিরুদ্ধে এমন কিছু না করা, যা চীনারা চাইবে না যে তারা চীনের বিরুদ্ধে করুক। এই ধারণাটি চীনের মানুষের এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বিদ্যমান রয়েছে এবং চীনের ব্যবহার আর মানসিকতায় তারই প্রতিফলন ঘটে। চীনের পূর্ববর্তী প্রজন্ম বিশ্বাস করত যে যুদ্ধভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলো ক্রমে ক্রমে বিলীন হয়ে যাবে, তা যত বড় রাষ্ট্রই হোক না কেন। আদিকাল থেকেই চীন বাণিজ্য আর যোগাযোগ বাড়ানোতে বিশ্বাসী, আক্রমণ আর আধিপত্য বিস্তারে নয়। চীন নিজের দেশকে দেশপ্রেমের মাধ্যমে রক্ষা করার প্রয়াস নিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করতে চায়নি।
দুই হাজার ১০০ বছর আগে চীনারা সিল্ক রোড সৃষ্টি করেছিল, যার মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার লেনদেন হয়েছে এবং যা সেই অঞ্চলের মানুষকে গভীরভাবে লাভবান করেছে। ৬০০ বছর আগে চীনের নাবিক জেংহি প্রশান্ত মহাসাগর আর পশ্চিম ভারত সাগরে একটি শক্তিশালী নৌবহর নিয়ে সাতবার সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন। তিনি যে ৩০টি দেশ সফর করেছিলেন, তার এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও তিনি দখল করেননি। তাঁরা শান্তি ও বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন এবং সেসব দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সাংস্কৃতিক বিনিময়েরই বীজ বপন করে এসেছিলেন। শি জিনপিংয়ের কথায় গণচীন প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত চীনের আধুনিক কালের ইতিহাস ছিল অবমাননা, পরাজয় আর বিপর্যয়ের। কিন্তু তা চীনের মানুষের বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং জাতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামেরও মহান ইতিহাস। চীনের মানুষ, যারা বহু বাধাবিপত্তির অভিজ্ঞতা অতিক্রম করেছে, তারা শান্তির কামনা করে এবং তাদের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা তারা কোনো দেশের ওপর চাপিয়ে দেবে না। শি জিনপিং তাঁর ভাষণের সমাপনী অংশে বললেন যে চীন শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রইবে এবং অন্যান্য দেশকেও সেই পথ অনুসরণ করতে উৎসাহিত করবে। চীন অধিকতর আন্তর্জাতিক দায়িত্ব গ্রহণ করবে, মানবতা ও আন্তর্জাতিক সুবিচারের জন্য অন্যদের সঙ্গে কাজ করে যাবে, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়াদিতে ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখবে এবং বিরোধ সমাধানে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা নেবে। বিশ্বশান্তি বজায় রেখে চীন উন্নয়নে লিপ্ত রইবে এবং উন্নয়নের মাধ্যমেই বিশ্বশান্তি আনয়নের পক্ষে রইবে। চীন সমতার ভিত্তিতে, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা ও মতানৈক্য সমাধানে সচেষ্টা রইবে এবং তাতে আন্তরিকতা ও ধৈর্যের পরিচয় দেবে। শি জিনপিং বলেন, চীনে একটি কথা আছে যে মানুষের মধ্যে সম্পর্কই আন্তরাষ্ট্র সম্পর্কের চাবিকাঠি এবং পারস্পরিক সমঝোতাই হলো মানুষের মধ্যে সম্পর্কের চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, ইউনেসকোর সদর দপ্তরে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত একটি বাণী তিনি পাঠ করেছেন। তা হলো, যেহেতু সংঘাতের সূচনা মানুষের মনে ঘটে, মানুষের মনেই নির্মাণ করতে হবে শান্তিরক্ষার কবচ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই ভাষণটি প্রাসঙ্গিক মনে হলো। এখানে অবশ্য বলার প্রয়োজন রয়েছে, চীনা ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বাংলায় আমার ভাষান্তরের প্রচেষ্টায় অনেক ভুলভ্রান্তি ও অসম্পূর্ণতা নিশ্চয় রয়েছে—তবে এই ভাষণটি থেকে যেকোনো দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে চীনের চিন্তাধারার একটি আভাস পাওয়া যায়। আমার এই দুর্বল প্রচেষ্টার কৈফিয়ত সেখানেই।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.