বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রীর বৈধতা by মিজানুর রহমান খান

তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ তাঁর নতুন বইয়ে লিখেছেন, মুজিব কাকুর পাশেই আনন্দ-উদ্বেলিত আব্বু দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হঠাৎ মুজিব কাকু আব্বুর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, ‘তাজউদ্দীন, আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হব।’ তিনি এর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এ নিয়ে সাংবিধানিক শুদ্ধতার প্রশ্ন উঠেছিল। ভিন্ন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মুজিবের পক্ষেই রায় দিয়েছেন।

গত ২৫ মার্চ তারেক রহমান ‘জিয়া প্রথম রাষ্ট্রপতি’ এবং ৮ এপ্রিল ‘মুজিব অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ উল্লেখ করেন। ১৫ এপ্রিল মির্জা ফখরুল ইসলাম তারেককে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তুলনা করে তারেকের মতো অধ্যয়নের পরামর্শ দেন। তাঁর কথায়, তারেক কতিপয় ঐতিহাসিক সত্য উদ্ঘাটন করেছেন, যা কিছু বই দ্বারা সমর্থিত। তারেক যদি ভ্রান্ত হন, তাহলে উপযুক্ত প্রমাণাদি দ্বারা তিনি তা প্রমাণ করতেও বলেছেন। কৌশলগতভাবে তারেক সফল, ক্ষমতাসীন দলকে তিনি রাগিয়ে দিতে পেরেছেন।
বিষয়টি আমরা আলোচনা করব, যার মূল লক্ষ্য এটা দেখানো যে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কীভাবে শাসনগত মূল সংকট (যা নির্বাচন থেকে উদ্ভূত নয়) থেকে মানুষের চোখ আড়াল করে রাখতে তৎপর রয়েছে।
জিয়া প্রথম রাষ্ট্রপতি—এ কথার একটি রাজনৈতিক ভিত্তি ও মাত্রা থাকতে পারে। ২০ এপ্রিল কর্নেল অলি আহমদকে ফোন করি। লন্ডনের অক্সফোর্ড ব্রুকস ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০২ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের বিবরণ ২৫ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিলেই সীমাবদ্ধ। ‘আপনি কি সেখানে জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন?’ তাঁর সংগত উত্তর: ‘নট অ্যাট অল। থিসিসে এ রকম সুযোগ থাকে না। তবে এটা অন্তর্গত। জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়েছিলেন।’ এটুকু আমরা জানি।
পরিহাস হলো, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা সনদ জিয়াকে নয়, প্রথম রাষ্ট্রপতি যেমন, তেমনি স্বাধীনতার ঘোষণাকারী হিসেবে মুজিবকেই নির্দিষ্ট করেছে। অথচ তারেক সেই সনদের ভিত্তিতেই বলছেন, মুজিব অবৈধ প্রধানমন্ত্রী। কারণ, সনদে লেখা ছিল, ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মুজিব রাষ্ট্রপতি থাকবেন।’ মওদুদ আহমদ ১৯৮৩ সালেই তাঁর শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল বইয়ে বঙ্গবন্ধু কেন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তার বিস্তারিত ব্যাখ্য দিয়েছেন। তাঁর বই তারেক রহমানের যুক্তি খণ্ডন করেছে।
ড. কামাল হোসেন তাঁর বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস বইয়ে লিখেছেন, ‘বিমানেই বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে সরকারের সম্ভাব্য ধরন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি দেশে ফিরছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। আওয়ামী লীগ সর্বদাই সংসদীয় পদ্ধতি সরকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। আমি স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় সরকারের পক্ষেই মত দিই। এটা ছয় দফায় ছিল।’
২০১৩ সালে প্রকাশিত বইয়ে কামাল হোসেন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার কর্তৃত্বে নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ দরকার ছিল। যে মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে জবাবদিহি করবে। এটা সমষ্টিগত জবাবদিহির ধারণাকে সামনে আনবে। আমরা মনে করি, তর্কবিতর্ক করতে হলে এটাই আসল সাংবিধানিক পয়েন্ট। বাদবাকি সবই অসার ও বালখিল্য।
বাহাত্তরের ১১ জানুয়ারি আবু সাঈদ চৌধুরী, কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলাম সাময়িক সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিলেন। এর আওতায় ১২ জানুয়ারির সকাল থেকে বদলটা ঘটেছিল এভাবে। রাষ্ট্রপতি মুজিব প্রথমে সায়েমকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। তাঁর মাধ্যমেই প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুজিব শপথ নেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগ করেন। তখন মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির শূন্যপদে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়োগ করেন। সায়েম ‘দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে জনাব চৌধুরীকে শপথ দেন। এরপর তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্য পদত্যাগ করেন।
এই পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি চৌধুরী সাময়িক আদেশের ৭ নম্বর ধারাবলে শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী কমিশন (নিয়োগ) করেন। লক্ষণীয়, সাময়িক আদেশে অ্যাপয়েন্টমেন্ট শব্দের পরিবর্তে কমিশন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কারণ, কমিশন অর্থ ক্ষমতা অর্পণ। সুতরাং এটা ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী একটি সাংবিধানিক রূপান্তরকরণ।
কিন্তু মুজিব রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন কেন? মওদুদের ভাষায়, প্রথম কারণটি ছিল রীতিমতো ঐতিহাসিক। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্ব নিয়ে আইনসভা বঙ্গদেশে প্রচলিত ছিল প্রায় ৫০ বছর যাবৎ। দ্বিতীয়ত, জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। সাময়িক সংবিধান আদেশ প্রণয়ন করে শেখ মুজিব এই ভেবে গর্ব অনুভব করেছিলেন যে তিনি জনগণের কাছে তাঁর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বাস্তব রূপদানে সফলকাম হলেন। তৃতীয়ত, যুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্বে অবস্থান করে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতপন্থী চিহ্নিত হয়েছিলেন। তাই কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক কারণেই প্রচলিত সরকারব্যবস্থা পাল্টে নতুন ধরনের সরকার গঠন অধিকতর উত্তম হবে বলে শেখ মুজিব মনে করেছিলেন।
মওদুদের ওই ভাষ্য নিশ্চয় যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু মোটা দাগে তাঁর এই অভিমতের সঙ্গে আমরা বেশি একমত যে, ‘সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছিল এক ব্যক্তির হাতেই। বাস্তবে সংসদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মন্ত্রীরা নিজের কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদ থেকে অপসারণের সব ধরনের অধিকার ছিল স্থগিত।’
বাকশাল থেকে একটি শাসন পর্বকেও আমরা আধা আদর্শস্থানীয় বলতেও অপারগ। প্রধান নির্বাহীকে অপসারণের সব গণতান্ত্রিক পথ সব সময় রুদ্ধই থাকে। আজও রুদ্ধ। তাই এ ধরনের অন্তঃসারশূন্য, ভুয়ো তর্ক তুলে ওঁরা আমাদের বিভ্রান্ত রাখতেই ব্যতিব্যস্ত। অবশ্য শেরাটনে ড. কামাল হোসেনের সম্মানে বই প্রকাশের নৈশভোজে বিএনপির এক নেতা রসিকতা করে বললেন, প্রথমে ভেবেছিলাম তারেকের বলাটা ঠিক হয়নি। পরে ভাবলাম ঠিক হয়েছে। কারণ, জিয়াকে তাঁরা রাজাকারের পর্যায়ে নামিয়েছিল। এখন তারেকের ওষুধে কাজ দিচ্ছে! এটা বাস্তবতা হলে তা জাতীয় মনোবৈকল্যের প্রতিফলন বটে।
সম্পূর্ণ ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া দুরূহ। মওদুদ লিখেছেন, আমাকেও বলেছেন, ল কনসালট্যান্স নামক একটি উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান সাময়িক সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করেছিল। আমীর-উল ইসলাম ও তাঁর যৌথ প্রতিষ্ঠান ছিল এটি। মতিঝিলের টেক্সটবুক বোর্ড ভবনের একটি কক্ষে তাঁদের অফিস ছিল। এটা দুজনেই সমর্থন করেন। কিন্তু এ নিয়েও ভিন্নমত আছে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য এই লেখককে বলেছেন, খসড়াটি হেয়ার রোডেই তৈরি হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকা একজন আমাকে বলেছেন, ‘১১ জানুয়ারি হেয়ার রোডের মন্ত্রিসভার বৈঠকে সাংবিধানিক শুদ্ধতার প্রশ্নে আমি গণপরিষদের অধিবেশন ডাকতে যুক্তি দিয়েছিলাম। সেটা গৃহীত হয়নি।’ তাই বলে কি মুজিব অবৈধ হয়ে যাবেন? তিনি নেতিবাচক উত্তর দেন, আমার হাতে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় তুলে দেন।
১৯৭৩ সালের ২২ আগস্ট প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েম ও বিচারপতি এ বি মাহমুদ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগ সাময়িক সংবিধানের বৈধতার প্রশ্ন যাচাই করেন। ১৯৭২ সালের দালাল আইনের বৈধতা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। অভিযুক্তের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে স্বাধীনতার সনদে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি ছিল। কিন্তু সনদে রাষ্ট্রপতিকে গোটা সরকার পদ্ধতিই বদলে দেওয়ার মতো সাংবিধানিক বিধান তৈরি করার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়নি। এর ফলে স্বাধীনতার সনদের লঙ্ঘন ঘটেছে। সাময়িক সংবিধান আদেশ করে রাষ্ট্রপতি নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুকূলে রাষ্ট্রপতি নিজের ক্ষমতা পরিত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মুজিব এটা পারেন না।
স্বাধীনতার সনদে রাষ্ট্রপতিকে ‘সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগ তাই ওই যুক্তি নাকচ করেন। বলেন, ‘সনদে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগসহ “বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক এবং ন্যায্য সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সব পদক্ষেপ” গ্রহণের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে বহুদূর প্রসারিত করার ব্যাপকতর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের মতে, স্বাধীনতার সনদে রাষ্ট্রপতিকে যেকোনো আইন কিংবা আইনগত বিধান এমনকি সাংবিধানিক প্রকৃতির হলেও তা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।’ সুতরাং মুজিবকে ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ দাবি করা সুপ্রিম কোর্টের এই রায়মতে অবৈধ।
রাজনৈতিক বিবেচনাতেও তারেক যে বিতর্কের সূচনা ঘটিয়েছেন, তা অপ্রাসঙ্গিক এবং বিদ্বেষপ্রসূত। এর বিরুদ্ধে যে বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে, তাও অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু যেটা প্রয়োজনীয় সেই বিষয়ে দুই যুযুধান শিবির যথারীতি এককাট্টা। আর সেটা হলো ড. কামাল হোসেনের ওই সমষ্টিগত নেতৃত্বের বিষয়ে দেওয়া মন্তব্যের অন্তর্নিহিত চেতনা থেকে দূরে থাকা। সমষ্টিগত নেতৃত্বের ধারণা আওয়ামী লীগের দলীয় গঠনতন্ত্রে বহাল ছিল। শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করার পর আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র থেকে সমষ্টিগত নেতৃত্বের বিধানটি বিলোপ করা হয়েছিল। এটা তারা মুখে আনে না। তারেককে তাঁরা গাল পাড়েন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি মুজিব কেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী হতে তাড়াহুড়ো করলেন, আর কেনই বা মাত্র দুই বছর যেতেই বাকশাল করলেন, তার সদুত্তর তাঁরা দেন না।
সাময়িক সংবিধানে তো লেখা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে। রাষ্ট্রপতি তাঁর সব কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সম্পন্ন করবেন। সাময়িক সংবিধানেও প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি ন্যস্ত করা হয়নি। স্বাধীনতার সনদে সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে ছিল। ১১ জানুয়ারি সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তনের পরেও রাষ্ট্রপতির সেই অবস্থান বদলানোর দরকার পড়েনি। এই অবস্থানটি ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রে যথারীতি অটুট রয়েছে।
সুতরাং অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের সূত্রে আসুন আমরা খেয়াল করি বর্তমান সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এমনকি তা স্বাধীনতার সনদ এবং সাময়িক সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তিনটি মৌলিক দলিল একটি অপরটির পরিপূরক হতে হবে। সংবিধানকে স্বাধীনতার সনদ ও সাময়িক সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করুন। রুগ্ণ আলোচনা বাদ দিয়ে সুস্থ আলোচনাটা অন্তত শুরু করুন।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.