শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ

রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল মানবসৃষ্ট জাতীয় বিপর্যয়। ট্র্যাজিক এই ঘটনা কেবল দেশবাসীকে ব্যথিত ও বিচলিত করেনি, এ নিয়ে বহির্বিশ্বে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যেসব দেশ আমাদের দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে, সেসব দেশের নাগরিকেরা জোরালো প্রতিবাদ জানান। রানা প্লাজা ধসের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের ওপর থেকে জিএসপি-সুবিধা স্থগিত করে দেয়। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও তীক্ষ নজর রেখেছে বাংলাদেশের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই খাতটির প্রতি। রানা প্লাজার বিপর্যয়ের পর নিহত শ্রমিকদের পরিবার এবং আহত শ্রমিকদের সহায়তায় সরকার, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এগিয়ে এলেও যাঁদের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই মালিকপক্ষের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। যদিও দুর্ঘটনার দায় সেখানে অবস্থিত শিল্প-কারখানার মালিকেরা কোনোভাবে এড়াতে পারেন না। দায় এড়াতে পারেন না, যে ভবনে কারখানাগুলো স্থাপন করা হয়েছিল, সেই ভবনের মালিকও। আদালতের নির্দেশে সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি রানা প্লাজা ধসে হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছে এবং শিগগিরই এটি আদালতে জমা দেওয়া হবে। কমিটি নিহত, নিখোঁজ (যাচাই সাপেক্ষে) শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিককে ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা, এক হাত বা পা হারানো শ্রমিককে সাড়ে সাত লাখ টাকা, দীর্ঘদিন চিকিৎসা প্রয়োজন এমন শ্রমিককে চার লাখ টাকা এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রমিককে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
বর্তমান বাজারমূল্যে এই ক্ষতিপূরণ কোনোভাবেই অতিরিক্ত বলা যাবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) কর্তাব্যক্তিরা রিপোর্ট হাতে না পেতেই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। তাঁদের পক্ষে এককভাবে এই ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া সম্ভব কি না, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু নীতিগতভাবে এটা মানতেই হবে যে এ ক্ষতিপূরণ যৌক্তিক। কমিটির সদস্য ও শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরীও এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছেন, প্রথমে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হলেও বিজিএমইএর আপত্তির কারণেই অর্থের অঙ্ক কমিয়ে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা করা হয়েছে। তাহলে এখন বিজিএমইএ আপত্তি করছে কেন? তাদের মনে রাখতে হবে যে শ্রমিকের ঘামে ও শ্রমে তৈরি পোশাকশিল্পের এত উন্নতি, সেই শ্রমিকের প্রতি তাদের নৈতিক ও আইনি কর্তব্য রয়েছে। সেই কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকশিল্পের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে রানা প্লাজায় অবস্থিত কারখানার মালিক কিংবা তাজরীনের মালিককে তারা কতটা বাধ্য করতে পেরেছে, সেই প্রশ্নও জরুরি। সরকারের কাছ থেকে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা নানা রকম সুবিধা নিলেও শ্রমিকদের সামান্য সুবিধা বাড়াতে তাঁদের অজুহাতের শেষ নেই। পোশাকশিল্পের মালিকদের এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। বিজিএমইএকে সরকারি কমিটির সুপারিশ মেনে নিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের জন্য এই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.