কূটনীতি : দুনিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীনতম পেশা by মহিউদ্দিন আহমদ

১৯৬৭ সালের খুব সম্ভব অক্টোবর মাসের কোনো একদিন লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আমাদের প্রবেশনারি জীবনের শুরু। এই লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে সেই জমানায় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) এবং পিএফএস পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের নবীন কর্মকর্তাদের এক বছরের কাগজ-কলমের প্রশিক্ষণ নিতে হতো। থাকা-খাওয়া, প্রতিদিন সকাল-বিকাল ঘোড়ায় চড়া, টেনিস খেলা এবং লেখাপড়ার সব ব্যবস্থাই এই সিভিল সার্ভিস একাডেমি কমপ্লেক্সে ছিল। আমাদের সেই ১৯৬৭-৬৮ ব্যাচে ২০ জন সিএসপি এবং ১৫ জন পিএফএম প্রশিক্ষণার্থী- সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। তবে এ বছর আমাদের বাঙালিদের সংখ্যাধিক্য ছিল। সর্বপাকিস্তান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে তখন এই নিয়োগগুলো হতো। আমাদের বছর ২০% মেরিট কোটার ৪ জনের ৩ জনই বাঙালি ছিলেন। প্রথমজন শাহেদ সাদউল্লাহ কয়েক বছরের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। এখন লন্ডনে উর্দু ‘দৈনিক জং’ পত্রিকার সম্পাদক। দ্বিতীয়জন ড. মিজানুর রহমান শেলী, চাকরি জীবনের সাত-আট বছরের মধ্যে তিনিও চাকরি ছেড়ে দেন। (‘নেম ড্রপিং’ করছি না, আসলেই তিনি আমাদের ব্যাচমেট ছিলেন; যেমন ছিলেন ড. আকবর আলি খান।) এখন ঢাকার একটি ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’-এর প্রধান এবং তৃতীয়জন আবদুশ শাকুর কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তো প্রবেশনারি জীবনের শুরুতে ক্লাসে এক অতিথি বক্তা খুব সম্ভব পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের এক সচিব রিজভী সাহেব আমাদের ফরেন সার্ভিস কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে ডিপ্লোম্যাসি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ পেশাটিকে দুনিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীনতম পেশা হিসেবে বর্ণনা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, তাহলে দুনিয়ার প্রথম প্রাচীনতম পেশাটি কী? পাশে উপবিষ্ট ছিল ফরিদ; ড. শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, ২০০১ সালে, তখনকার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি। ফরিদ ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টেও তিন বছরের অনার্স ক্লাসগুলোতে ক্লাসমেট সুতরাং একটু বেশি ঘনিষ্ঠ। ফরিদ একজন মেধাবী ছাত্র, অনার্স এমএতে ফার্স্ট ক্লাস, দুটোর একটিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টও। সুতরাং তার জ্ঞানগরিমা প্রত্যাশিতভাবেই বেশি।
ফরিদ কয়েক সেকেন্ড আমার প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু আমি ছাড়লাম না তাকে। এক রকমের বাধ্য হয়েই ফরিদ বলল, ‘প্রস্টিটিউশন’ দুনিয়ার প্রাচীনতম পেশা।
একটি ধাক্কা খেলাম। ডিপ্লোমেসি হল ‘গ্ল্যামারস’ একটি ‘প্রফেশন’, তাই শুনে এসেছি। করাচি ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়ার সময় করাচিতে কিছু রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিবিদদের দেখে তা-ই মনে হয়েছে। আর এই ‘ডিপ্লোমেসি’, প্রস্টিটিউশনের পরের প্রফেশন!
পরে দেখেছি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, পলিটিকসকেই দ্বিতীয় প্রাচীনতম পেশা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি পলিটিকস প্রফেশনকে দুনিয়ার প্রথম প্রফেশনের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি করে এ প্রসঙ্গে তার উদ্ধৃতিটি এমন পেয়েছি : 'It has been said that politics is the second oldest profession. I have learned that it bears a striking resemblance to the first.' (রাজনীতিকে দ্বিতীয় প্রাচীনতম পেশা হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। আমি আরও শুনেছি, দুনিয়ার প্রাচীনতম পেশাটির সঙ্গে এই রাজনীতি পেশার দারুণ মিল রয়েছে।)
দুই.
দেবযানী খোবরাগাড়ে নামের এক ভারতীয় মহিলা কূটনীতিবিদকে নিউইয়র্কে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ভারতে দারুণ তোলপাড় চলছে এখন। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা ও টিভিতেও এ খবর গুরুত্ব পাচ্ছে। নিউইয়র্কে এই কূটনীতিবিদ ডেপুটি কনসাল জেনারেল ছিলেন। দেবযানী খোবরাগাড়ে ভারত থেতে সঙ্গীতা রিচার্ডস নামের যে কাজের মেয়েকে নিউইয়র্কে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে আমেরিকান আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য নিুতম মজুরি প্রতি ঘণ্টায় ৯ ডলার দিচ্ছিলেন না বলে কাজের মহিলাটি মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে। এই ভারতীয় কূটনীতিবিদ ১২ ডিসেম্বর সকালে তার বাচ্চাদের স্কুলে নামাতে গেলে নিউইয়র্ক পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে, হাতকড়া পরায়, বিবস্ত্র করে তার শরীর সার্চ করে, ড্রাগ আসক্ত ক্রিমিন্যালদের সঙ্গে একই সেলে রাখে। ছয়-সাত ঘণ্টার মধ্যে অবশ্য দেবযানী খোবরাগাড়ে বেরিয়ে আসেন ব্যক্তিগত জামিনে। কিন্তু ভারতীয়দের জন্য ক্ষতি যা হওয়ার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। একজন কূটনীতিবিদ, তাও মহিলা। তেমন গুরুতর কোনো অপরাধ নয়, তারপরও তার সঙ্গে এমন আচরণ? ভারত সরকার এবং দেশটির আপামর জনসাধারণ যথার্থই মনে করল, এমন আচরণ ভিয়েনা কনভেনশনের গুরুতর লংঘন। সুতরাং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার নতুন দিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য শহরে কর্মরত মার্কিন কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে আট-দশ রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করল। ভারতের ফরেন সেক্রেটারি সুজাতা সিং জরুরি ভিত্তিতে দিল্লিতে অ্যামেরিকান রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ভারতে কর্মরত মার্কিন কূটনীতিবিদরা তাদের বাসাবাড়িতে কর্মরত কাজের লোকদের কী বেতন-ভাতা দিয়ে থাকেন তা জানাতে হবে, মার্কিন কনস্যুলেটে কর্মরত মার্কিন কূটনীতিকরা ভারত সরকার কর্তৃক ইস্যু করা পরিচয়পত্র ফেরত দেবে, কূটনীতিবিদ হিসেবে তারা বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত জিনিসপত্র- যেমন- খাবার-দাবার, মদ, গাড়িঘোড়া ইত্যাদির আমদানি বন্ধ থাকবে। সর্বোপরি দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তার ব্যবস্থায় দিল্লি পুলিশ দূতাবাসের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের যেসব ব্যারিকেড স্থাপন করেছিল তা তুলে নিয়েছে।
খুব ইন্টারেস্টিং একটি দাবি তুলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা। তিনি বলেছেন, ভারতে কর্মরত কিছু মার্কিন কূটনীতিবিদ সমকামী। এসব সমকামী কূটনীতিবিদদের পুরুষ সঙ্গীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ভারত সরকার যেসব ভিসা দিয়েছে, সমকামী কূটনীতিবিদদেরও ভারতে থাকার অনুমতি দিয়েছে, তা প্রত্যাহার করে এদের গ্রেফতার করতে হবে। কারণ ভারতে এটি একটি অপরাধ। নিউইয়র্কে দেবযানী খোবরাগাড়ে প্রযোজ্য ন্যূনতম বেতন না দিয়ে যদি অপরাধ করে থাকেন, তো এসব সমকামী মার্কিন কূটনীতিবিদরা তো আরও বড় জঘন্য অপরাধ করে চলেছেন ভারতের প্রযোজ্য আইন লংঘন করে!
কয়েক দিন আগে একটি মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি দল দিল্লি সফরে ছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, কংগ্রেস ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী, ভারতীয় জনতা পার্টির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারী, ভারত সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন, তারা এই মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রতিবাদে নির্ধারিত সব অ্যাপায়নমেন্ট বাতিল করেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। লোকসভা-রাজ্যসভায় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন সব রাজনৈতিক দল।
এনডিটিভি- নিউ দিল্লি টেলিভিশনে কয়েকদিন ধরেই দেখছি এই ভারতীয় মহিলা কূটনীতিবিদের প্রতি অগ্রহণযোগ্য আচরণ এবং এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ভারতীয়র মন্তব্য, মতামত গুরুত্বের সঙ্গেই প্রচার হচ্ছে প্রতিটি বুলেটিনে।
গত মঙ্গল বা রোববার রাতে দেখি একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে ভারতের দুই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব- ললিত মান সিং এবং কানওয়াল সিবালের সঙ্গে আর এক অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ রনেন সেন। আরও কয়েকজনসহ তারা কথা বলছেন। ললিত মান সিং এবং রনেন সেন দু’জনই ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কথা বললেন, আলাদাভাবে ভারতের এক প্রতিমন্ত্রী শশি থারুর। তিনিও একজন পেশাজীবী কূটনীতিবিদ এবং জাতিসংঘে আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন।
শশি থারুর বললেন, আমেরিকান আইন অনুযায়ী যদি কাজের লোকদের ন্যূনতম বেতন দিতে হয়, দেখা যাবে ওই বেতন তা ওই ‘হাউজমেড’-এর নিয়োগদাতা কূটনীতিবিদদের চেয়ে বেশি। কারণ কূটনীতিবিদদের তো বিদেশে ভারতীয় স্কেলে বেতন-ভাতা দেয়া হয়ে থাকে। ‘আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ডে’ তা অনেক কম। আমেরিকার প্রযোজ্য হারে বেতন দিতে হলে ‘হাউজমেড’ সঙ্গীতা রিচার্ডকে মাসে বেতন দিতে হয় প্রায় দেড় হাজার ডলার, প্রতি সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টা হিসাবে। ভারতীয় স্কেলে দেবযানী খোবরাগাড়ে হয়তো নিজে এত বেতন পান না। তবে বিদেশের দূতাবাসে বেতনের এই ঘাটতিটা পূরণ করা হয়ে থাকে ফরেন অ্যালাউন্স দিয়ে। তারপর তারা সরকার থেকে বাড়ি ভাড়াও পেয়ে থাকেন।
ইতিমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি দুঃখ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু ভারতীয়রা চাইছে মার্কিন সরকারকে মাফ চাইতে হবে। কংগ্রেস, বিজেপি- দলমত এবং পেশা নির্বিশেষে সব ভারতীয় তাদের একজন কূটনীতিবিদের পক্ষে, তাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যেমন ঐক্য দেখাচ্ছে আমি অভিভূত। আমাদের কি কখনও এমনটি হবে?
ইতিমধ্যে ভারত সরকার আরেকটি কাজ করেছে- দেবযানী খোবরাগাড়েকে এক কূটনৈতিক চালে নিউইয়র্কের ডেপুটি কনসাল জেনারেল পদ থেকে নিউইয়র্কে ভারতের স্থায়ী মিশনে বদলি করেছে।
তিন.
এখানে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের একটু ব্যাখ্যা দরকার। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদদের কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে, যেমন- তাদের ‘হোস্ট’ সরকার তাদের কর্মস্থল এবং বাসাবাড়ি এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, অতি গুরুতর কারণ ছাড়া তাদের গ্রেফতার করা যাবে না, তাদের মানইজ্জত, সম্মান সমুন্নত রাখতে হবে। এই কথাগুলো বর্ণিত আছে ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১’তে। যারা কনস্যুলেটে কাজ করেন তারা কূটনীতিবিদ ঠিকই, কিন্তু তারা কূটনৈতিক মিশনে কর্মরত কূটনীতিবিদদের মতো এত সুযোগ-সুবিধা পান না। ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে দেবযানী খোবরাগাড়ে সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী ছিলেন না বলে ভারত সরকার তাকে তাদের নিউইয়র্কের স্থায়ী মিশনে বদলি করে কূটনীতিবিদ হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী করে তুলেছে।
ভাইস কনসাল, কনসাল, কনসাল-জেনারেল- এরা সাধারণত বিদেশে দেশের নাগরিকদের দেখাশুনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করাও তাদের অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু একটু আগেই যেমন বলেছি, তারা দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের মতো দায়মুক্তি, মামলা-মোকদ্দমা থেকে অব্যাহতি এসব সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি পান না। এই শ্রেণীর কূটনীতিকদের অধিকার, সুযোগ-সুুবিধা বর্ণনা করা হয়েছে ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন্ কনস্যুলার রিলেশন-১৯৬৩’ তে। সুতরাং মনে রাখতে হবে, কূটনীতিবিদদের জন্য ভিয়েনা কনভেনশন দুটি প্রণীত হয়েছে।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার অনুবিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেল মো. শামীম আহসান ‘কূটনীতিকোষ’ ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ড়ভ উরঢ়ষড়সধপু নামের ৮৬৫ পৃষ্ঠার একটি মোটা বই লিখেছেন (প্রকাশক : এ এইচ ডেভেলপমেন্ট পাবলিসিং হাউস)। যশোর বোর্ডে ১৯৮৪ সালে মানবিক বিভাগে প্রথম, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স এমএতে ফাস্ট ক্লাস ফার্স্ট তুখোড় ছাত্র, এখন এক মেধাবী দক্ষ ফরেন সার্ভিস কর্মকর্তা এই শামীম আহসান এই ভিয়েনা কনভেনশন দুটো সম্পর্কে সংক্ষেপে কী লিখেছেন তা হুবহু নিচে তুলে দিলাম :
Diplomatic Relations 1961, Vienna Convention on (কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরে ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬১) ১৯৬১ সালের ১৮ এপ্রিল ভিয়েনাতে স্বাক্ষরিত চুক্তি। ৮১টি দেশের অংশগ্রহণে স্বাক্ষরিত চুক্তিটির উদ্দেশ্য ছিল : কূটনৈতিক এজেন্ট এবং মিশনগুলোর প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ও অব্যাহতি (diplomatic privileges & immunities)-এর উপরে বিদ্যমান প্রথাসিদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের সংকলন ও স্পষ্টীকরণ। উক্ত কনভেনশন ১৯৬৪ সালে কার্যকর হয় এবং বস্তুত প্রত্যেকটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রই উহার সদস্য (state parties)। এখানে উল্লেখ্য যে, উক্ত সুযোগ-সুবিধা কূটনীতিকদের ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য প্রদান করা হয় না। International Law Commission-এর বক্তব্য এখানে সুস্পষ্ট The purpose of such privileges and immunities is not to benefit individuals but to ensure the efficient performance of the functions of diplomatic mission as representing states. কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক উক্ত আইন স্বাক্ষর এটা নিশ্চিত করে না যে বা খুব কম ক্ষেত্রেই নির্দেশ করে যে, চুক্তির ধারাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে উহার মিউনিসিপ্যাল আইনের আওতায় কার্যকরী হবে। কেননা এক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় আইন প্রণয়নের (national legislation) প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ চুক্তিটি ১৯৭২ সালে স্বাক্ষর (accede) করেছে। কনভেনশনটি সংযুক্তি ২৮ এ দেখা যেতে পারে।
Consular Relations Vienna Conventions on (1963) (কনসু্যুলার সম্পর্কের ওপরে ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬৩) ১৯৬৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভিয়েনাতে অনুষ্ঠিত আলোচনার ফলে গৃহীত হয়। উক্ত কনভেনশনের লক্ষ্য ছিল কনসু্যুলার বিষয়ে বিরাজমান প্রথাসিদ্ধ আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে কনস্যুলার অফিস ও কর্মকর্তাদের সুবিধাদি, অব্যাহতি ইত্যাদি সংকলন ও স্পষ্টীকরণ করা। উক্ত কনভেনশন ১৯৬৭ সালে বলবৎ হয় এবং বিশ্বের অধিকাংশ দেশই উহা স্বাক্ষর করেছে। উক্ত কনভেনশনের আওতায় প্রদত্ত কূটনৈতিক সুবিধাদি প্রদানের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেন লাভবান হন তা নিশ্চিত করা নয় বরঞ্চ প্রেরণকারী দেশের মিশনসমূহ যেন দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান। উক্ত কনভেনশনকে আরও স্পষ্ট করার জন্য এবং উক্ত কনভেনশনে উল্লিখিত সুবিধাদি ও অব্যাহতি (privileges & immunities) প্রদানের জন্য, অনেক দেশ উহার উপর ভিত্তি করে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও সম্পাদন করেছে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কনভেনশনটি স্বাক্ষর (accede) করেছে। কনভেনশনটি সংযুক্তি ৯ এ দেখা যেতে পারে। (Consular Privileges & Immunities) দেখুন।
প্রথম কনভেনশনটিতে ৫৩টি ধারা, এখন পর্যন্ত ১৮৯টি দেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। দ্বিতীয়টির ধারা সংখ্যা ৭৯, ১৭৬টি দেশ সই করেছে।
চার.
আমাদের রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাহিত্যিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, কূটনীতি বিষয়ে যারা লেখালেখি করেন, মধ্যরাতের টকশোগুলোতে যারা এই রাষ্ট্র, ওই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গর্জন করেন, জিহাদ ঘোষণা করেন, শীতের রাতকে গরম করে তোলেন- তাদের জন্য ফরজ এই কনভেনশন দুটির অন্তত প্রথমটি মনোযোগ দিয়ে পড়া, পারলে গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো মুখস্থ রাখা। শামীমের বইটি হাতের কাছে রাখলে এই ‘পণ্ডিত’ বিশ্লেষকদের কথাগুলো বাস্তবসম্মত হবে। আর কনভেনশন দুটি অতি সহজে ইন্টারনেট থেকেও নেয়া যায়।
যারা ঢাকাস্থ ভারত, পাকিস্তান, মার্কিন দূতাবাস এবং দূতাবাসগুলোতে কর্মরত কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে হরহামেশা হুঙ্কার-হুমকি দিতে থাকেন, মিছিল-মিটিং সমাবেশ করেন, পারলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন, তাদের ভিয়েনা কনভেনশন অব ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ এর ২২ নম্বর ধারাটি মনে রাখতে বলি। এই ধারাটি এমন ‘Host country must protect the mission from intrusion or damage.’ (হোস্ট দেশ অবশ্য অবশ্যই দূতাবাসগুলোকে অনুপ্রবেশ বা ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে।)
মিছিলকারী এবং গর্জনকারীদের বলি, এখানে আমাদের সরকারটির একটি আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা আছে। বাংলাদেশে কর্মরত প্রতিটি দূতাবাস ও প্রত্যেক কূটনীতিবিদকে সব রকমের নিরাপত্তা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আমাদের সরকারের আছে। শেখ হাসিনার সরকারটি এমনিতেই নিজসৃষ্ট কতগুলো সমস্যার কারণে প্রত্যাশিত এবং অপ্রত্যাশিত, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক চাপে আছে। শেখ হাসিনার এই সরকারটির ওপর অতিরিক্ত আর কোনো চাপ সৃষ্টি করবেন না, প্লিজ।
সবশেষে বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হানাকে বলি, তিনি বলেছেন, বিজয় দিবসের জাতীয় অনুষ্ঠানে স্মৃতিসৌধে তারা যাননি, কিন্তু বিকালে বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে তো তারা গিয়েছেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার, আচার-আচরণ সম্পর্কে এই লোকের সামান্যতম জ্ঞান থাকলে তার জানার কথা, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোর কোনোটাই একটি আরেকটির বিকল্প নয়। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের প্রতিটিতে উপস্থিত থাকার মধ্যে রাষ্ট্রদূতদের এক রকমের বাধ্যবাধকতা আছে।

No comments

Powered by Blogger.