লুনার কাছে চিঠি by সাগুফতা শারমীন তানিয়া

সারাটা দুপুর নিঃশব্দে জাম ঝরবার সময়। সারা দুপুর শরশর শব্দে পেকে হলদে হয়ে যাওয়া পাতা ঝরে জানালার শার্সিতে। এই গাছগুলোর নাম প্লেইন ট্রি, আমি বাংলা করেছিলাম সরলগাছ, দ্বিজেন (শর্মা) কাকা বলেছিলেন এগুলো সরল গাছ না। এসব তাহলে জটিল গাছ। কাণ্ডে অনেক রং। হুইসলারের কালার প্যালেটের রং। লুনা, এসব দিনে বাসায় থাকতে থাকতে হঠাৎ কোনো বেলি-ড্যান্সারের পেটের ওপর শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তুলতুলে কোমল মেদ মাখানো সমুদ্র-সফেন পেটে। কোনো অচেনা মহিলার পিছু পিছু চলে যেতে ইচ্ছা করে, যার গায়ে স্টেইন্ড গ্লাসের মতন চকচকে রঙিন সব লজেন্সের গন্ধ। আমাকে শেখানো হয়েছে শব্দটা লজেন্স নয়, শব্দটা লসেঞ্জ। কিন্তু আমার যার পিছু নিতে ইচ্ছা করে তার গায়ে লজেন্সের গন্ধ। লুনা, তোর জন্য আমি একটা সাবানের বাক্স কিনেছিলাম। বাক্সটার গায়ে অনেকগুলো বেগনি প্রজাপতি আর রুপালি জোনাকি আর অস্পষ্ট ইংরেজিতে কী সব লেখার ভান করা। বাক্সটায় সুরের চাবি আছে, চাবি ঘুরালেই চাইকভস্কির ‘সোয়ান লেক’ বাজতে থাকে। একদিন রাতে ‘সামার ইন্টারলুড’ দেখে আমি কেঁদেছিলাম, আমার বুকে বরফের ছুরি ঢুকে গেছিল। সেই রাত্রি আমি কতকাল আগে ফেলে এসেছি। সে রাতে শোনা সোয়ান লেক।
এখন একলা টয়লেটের ছায়াময় অন্ধকারে আমি চাবি দিয়ে সাবানের বাক্সটা বাজাই, রাজহাঁস-প্রজাপতি আর জোনাকি একাকার হয়ে যায়, উড়তে থাকে, ঘুরতে থাকে। সামার ইন্টারলুডের চেয়ে আমার সে বয়সে অনেক ভালো লেগেছিল ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’, আমার ভেতরটা খুশিতে চমকে উঠেছিল যখন আইজ্যাকের প্রায়-যান্ত্রিক ডাক্তার ছেলেটা সরল স্বীকারোক্তিতে তার ভালোবাসা জানিয়েছিল। লুনা, কবেকার হুমায়ুন ফরীদির একটা চিৎকার মনে পড়ে আমার, ‘বেলায়েত! এটাই হয়তো সুস্থ অবস্থায় তোকে লেখা আমার শেষ চিঠি’... বা এই জাতীয় কিছু। কার লেখা নাটক মনে নেই, সুবর্ণা ছিল, স্যানাটোরিয়াম থেকে পালিয়ে আসা তরুণী, যে বিশ্বাস করত সে হুমায়ুন ফরীদির স্ত্রী। মনে হয় রাবেয়া খাতুনের লেখা গল্প। এ রকম একটা মুভি দেখেছিলাম পরে, অতল জলের আহ্বান। আমাদের এখানে দলবেঁধে ধূসর মেঘ চলেছে উত্তরে। ধোঁয়ার মতন রং তাদের। উত্তরের বাতাস আছড়ে পড়ছে ক্রমাগত জটিল গাছগুলোর গায়ে, পাতা খসানোর সময় শুরু হয়ে গেছে। বিছুটি গাছে ভরে গেছে বাগান। আর গোলাপ মরতে শুরু করেছে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে পাতাঝরা দেখতে দেখতে আমারও মাঝেমধ্যে চিৎকার দিতে ইচ্ছা করে, ‘বেলায়েত!’ নাই-বা তাহার অর্থ হোক/ নাই-বা বুঝুক বেবাক লোক...
২. আমার ছেলে কুশান আমার ২৩ বছর বয়সের ছবি বুকে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরছে, এটা নাকি তার মায়ের ফটো। আমি ছবির ফ্রেমটা কেড়ে নিই, ২৩ বছরের আমি আম্মার লালপেড়ে শাড়ি পরে রোদে দাঁড়িয়ে আছি, ওই মেয়েটা কিছুতেই কুশানের মা নয়, তার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে কুশানাকার কিছুই ছিল না। ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি’ এসব ফালতু কথা। কে বোঝাবে! মাথা দুলিয়ে কুশান আবার বলে, ‘ইটস মেমে’ (মেমে মানে মা)। একটা হরর স্টোরিতে পড়েছিলাম এক যুবকের কথা, অল্প বয়সে বাপ-মা হারিয়ে বড় হয়ে এক আধা শহরে কাজে যায়, কাজ শেষে মফস্বলি এক সিনেমা হলে ঢোকে। একসময় আবিষ্কার করে তার পাশে এসে বসেছে এক তরুণ। বিস্ময়করভাবে তার মুখ চেনা (বাবার মুখ)। তরুণটির সঙ্গে সে অদ্ভুত আকর্ষণবশে তার বাড়ি যায়, অবশ্যম্ভাবীভাবে আবিষ্কার করে তার তরুণী মাকে। খুব সহজ যত্নে তারা যুবকটিকে খেতে দেয় গরমকালের তরমুজ। সে ভেবে পায় না এই যুবক সন্তানকে এরা এত সহজে নিচ্ছে কী করে, এরা তো একে দেখেইনি কখনো। অথচ কত মমতায় হাত-মুখ ধুয়ে আসতে বলল, কী আত্মীয়তার সুরে তার সঙ্গে চিরপরিচিতের মতন করে কথা বলল। পরবাস ওই রকম, দূরে চলে যাওয়া কাছের মানুষকে আরেক রকম করে দেখা, চিরপরিচয়ের সুর বাজে, কিন্তু সে সুর সুদূর মেঘের ধ্বনির মতন। সংগীতহীন। স্বরলিপিহীন।
৩. নিজের ভেতরে সুতোকাটুনি, ভাবনাদের অনর্গল নির্গত রূপ কাটা-সুতোর মতনই। প্রলাপের মতন। একরকমের একরৈখিক মনোলগ, যার গন্তব্য নিয়ে রেখা স্বয়ং ভাবিত নয়, প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে ছুটে চলাই তার কাজ। লুনা, উদ্দেশ্য বিধেয়বিহীন, উৎসববিহীন, আনন্দবিহীন, পরিকল্পনাবিহীন একটি দোলকের মতন শূন্যে দোলায়মান জীবন চাই আমার, যেখানে কোনো দিন মনে পড়বে না ‘খেতে আসো’ ডাক, কোনো দিন মনে পড়বে না মহামাতৃকুলের হালুয়া বানানোর রাত্র -প্রিয়জনের কাছে ক্ষমা চাওয়া, কোনো দিন মনে পড়বে না আরেকটা অনাগত সুন্দর বছরের প্রতীক্ষা।
৪. ঘুমন্ত মাথায় ছলাৎ ছলাৎ করে এসে লাগে ছোট ছোট জাগৃতির ঢেউ, ওয়াটার কালারে করা ছবির শুকিয়ে আসার মতন দুনিয়াটা পষ্ট হতে থাকে, আর্থার মিলার সেই রকম সময়ে সকালবেলা চোখ না খুলেই হাত বাড়িয়ে দেখতেন পাশে স্ত্রী আছেন কি না। ৮০ বছর বয়সে তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের জন্য আমার মাথায় একটু ফাঁকা স্থান ছেড়ে দেওয়া আছে। আমি তাঁকে বিশ্বাস করতাম, যদি তিনিও আমাকে...’ মায়া সভ্যতার বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী দিন গড়ায় আমার। সকাল শেষ হয় না। দুপুর প্রায় শালগ্রামশিলার মতো স্থাণু। আর সন্ধ্যার আলো থাকে গভীর রাত অব্দি (অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থায়ী জোনাকি নীল)। আমি আমার কররেখার মতন করে শুধু একটা দিনকে জানি। যেদিন আমি আত্মহত্যা করব।সেদিন কী দিয়ে সকালের নাশতা খাব। কেমন অবলীলায় কর্নারশপে মৃতপ্রায় শাকসবজি—আর পুরোনো মাশরুমের কোঁচকানো স্তনবৃন্ত পার হয়ে যাব। রেলগাড়ির জানালা দিয়ে ধূসর আকাশে দেখব ধূসর ডানার চিল (হায় চিল)। ঈশ্বর আমাকে পরিত্যাগ করার সুযোগ পাবেন না সেদিন,
তার আগে আমি পরিত্যাগ করব তাঁকে। শুধু জানি না লুনা, শেষবারের মতন আমার কার মুখ দেখতে ইচ্ছা হবে। আমার প্রিয়তম মুখগুলোর তো কোনো মুখই ছিল না। মুখচ্ছবি দিয়ে আমি তাদের চিনি নাই, শুধু আমার জন্য তারা তাদের ভ্রুকুটি ফেলে গেছে। আমি কি গুনগুন করব? কারও জন্য খুব দুঃখ হবে আমার? আচ্ছা আমার কি তাহলে কবর হবে, লুনা? সাইপ্রাসের ফিসফিস, ছায়াচ্ছন্ন কবর। চাপচাপ অন্ধকারে পোকামাকড়েরা আমার হূদয়—আমার হূদয়ে ফেলে যাওয়া ভ্রুকুটি, আলোর ঝালর সব খেয়ে ফেলতে থাকবে? না না, তার চেয়ে দাহ করা হোক আমাকে। আমার ছাই ফেলে দিয়ে আসবি তুই, প্রিয় কোনো বাগানে। কিন্তু আমার প্রিয় বাগানও যে অসংখ্য—সব ভস্মে চিহ্নিত করে দিয়ে যেতে চাই। আচ্ছা, এত কিছু ‘আমার’ ভেবে নিয়ে মরে যাওয়া কি ঠিক হবে? প্রতারণা হবে না? লুনা? (তার চেয়ে এই ভালো—ফেসবুক খুলে দেখি তুই লিখে রেখেছিস—‘ওই আমারে তোর সুইসাইড নোট দেখা। একা একা লিখতে পারি না, তোরটা দেইখা দেইখা লিখমু!’)
৫. বাইরে অনেক কিছু হবে লুনা। ঘাস বড় হতে হতে শিষ ধরবে। গোলাপের দিন ফিরবে। ধুলার দিন। আমি আবার আগের মতন কাঁথার ভেতরে—সিলিং ফ্যানের শব্দের ভেতরে—মাথার ভেতরে নিমজ্জমান হতে হতে ‘হামারি বহু অলকা’ দেখব, তারপর চিত্রনায়িকা রেখার দুই বেণীর নাচন দেখব—‘আউঙ্গি এক দিন আজ যাউ’... আর আমি সব চিন্তাকে কাঁথার মতন ভাঁজ করে, সিলিং ফ্যানের মতন ডিসম্যান্টেল করে তলিয়ে যেতে থাকব। ‘যেখানে আনন্দ অধীন নয়, বিষাদেও অধিকার নাই...’
৬. আমাদের বাড়ির রাস্তার নাম জেন অস্টেনের এক বিখ্যাত নায়িকার নামে—একটা কানাগলিতে। কানাগলি গোল হয়ে ঘুরে এলে তার নাম হয় কাল-ডে-স্যাক। কিন্তু কানাগলি যদি চলতে চলতে অবশেষে নাকের ডগায় গুঁতো খায় একটা অনতি উচ্চ দেয়ালে, যেখানে উঁকি দিচ্ছে বিছুটির ফুল আর দোল খাচ্ছে চোরকাঁটার মাথা—তাহলে? গলির মুখটা কি তখন বোকা বোকা হবে? গলি তখন বিচলিত চোখে ইতিউতি তাকাবে? বিয়েবাড়িতে ছোটবেলায় আমাদের মুখ যেমন হতো, তেমন? এসব ভাবনা শেষ করে ফেসবুকে কাউকে পাস্তা কারবোনারা বানানো শিখাই, নিজে মানকচুর জিলাপির ছবিতে লাইক দিই। তোকে অনলাইনে খুঁজি লুনা। তুই কবে আসবি, কবে ছুটি। রৌদ্রের দিনে আবার বাগানে আসি, আমি আর কুশান খুঁজে পাই করোটি আকারের কালো পাথর আর বৃক্কের দৈর্ঘ্যচ্ছেদের মতন দেখতে নুড়ি। পাখি আসে আমাদের বাগানে। ইংরেজিতে একটা উপমা আছে, ‘নেকেড অ্যাজ আ জে-বার্ড।’ জে-বার্ডরা নগ্ন শুধু, আর সব পাখির পরনে কাপড়? ম্যাগপাইদের দেখলে অবশ্য মনে হয় আঁটসাঁট কর্সেট পরে আছে। আমার ছেলে আমাকে পাথর উপহার দেয় কেবল, গোলালো, পলিশ করা, ছোট ছোট নানা রঙের পাথর, তার বিস্ময়ের আকার হলো পাথরের মতন।
আর তার উপহার হলো ফুল—এমনি ফুল না। ঘাসে গজিয়ে ওঠা ডেইজি।  সাদা পাপড়ি। হলদে পরাগমণ্ডলী। (শিউলি ফুলকে মনে পড়িয়ে দেয় কেন জানি না। কোথায় পড়েছিলাম শিউলির নাম ফ্লাওয়ার অব স্যাডনেস।দেখলেই সে উবু হয়ে তুলতে লেগে যায়, ঘোষণা দেয় মায়ের জন্য তুলছি। মায়ের জন্য তোলে বটে, কিন্তু মায়ের হাতে দিতে ভুলে যায় মাঝে মাঝে। পকেটে রেখে দেয়, আমি তার জ্যাকেট ঝাড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি পকেটে কবেকার দলিত শুষ্ক ডেইজি। দিকনির্দেশহীন ভালোবাসা হলো মসৃণ কালো পাথর। আর শুকনো ডেইজি। ঘাসের শিষের নুয়ে পড়া দেখে কবেকার সর্ষেবালার নুইয়ে পড়া মনে করেছি, চৌকাঠে বসে। নীল নোয়ানো আকাশ দিয়ে এখানে উড়োজাহাজ যায়, হাওয়াই জাহাজ। (মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের নানা বাড়িতে মেয়েদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, ‘হামারা বাপ হাওয়াই গাড্ডিমে কাম করতা হ্যায়’) ভয়। বিভীষিকা। ক্ষুধা। এসব থেকে আমি এখন দূরে। (বিদায় দে গো শচীরানী আমি সন্ন্যাসেতে যাই) আসলেই কি দূরে?
৭. ‘তেপান্তরে নাচে একা আলেয়া’...কী সুন্দর যে লাগত লাইনগুলো, লুনা। তখন কার্তিক মাসে আসলেই কয়েক দিন ধরে আচ্ছামতো বৃষ্টি হতো এবং ঘরে ঘরে আজি রুদ্ধ দুয়ারই হতো। পরে শিখেছিলাম, এর নাম আইতান-কাইতান বৃষ্টি। আহা বৃষ্টির ভেতর হাত অর্ধবৃত্তাকারে মেলে ঘুরছেন ববিতা (অসহ্য দাঁতে নখ খোঁটার সলজ্জভাব, নির্ঘাৎ ববিতার সারা বছর কৃমি লেগেই থাকত, এই হারে নখ খেলে তো হবেই!) এখন কি শীত শুরুর আগ দিয়ে এ রকম বৃষ্টি হয়, জানতে ইচ্ছা করে। কালবৈশাখী দেখতে ইচ্ছা করে, দেখে দৌড় দিয়ে কাঠের জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা করে আর রৌদ্রে দেওয়া আচার তুলে আনতে ইচ্ছা করে। শিল কুড়িয়ে চুষতে ইচ্ছা করে। ঘর অন্ধকার করে শুকাতে দেওয়া ভেজা কাপড়ের ঘ্রাণ পেতে ইচ্ছা করে। সব ইচ্ছা এ রকম নিরুপায় দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তুলে রাখতে ভালো লাগে না... বুড়ো আর্থার মিলারের মতন আমিও আধা জাগন্ত হাত বাড়িয়ে অন্ধকার হাতড়িয়ে খুঁজি—বাংলাদেশ, তুমি কই। আমার অভয়দাত্রী মা-গন্ধী শরীরের বাংলাদেশ? বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ, তোমাকে যোজন যোজন দূর থেকে ভালোবাসা কত্ত সহজ।
তোমার ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে পুড়তে থাকা নিউমার্কেটের চাতাল, কাটা কাপড়ের দোকানের গন্ধ আর সেঁকরার সবুজ রং করা দেয়ালের দোকান। তোমার প্রথম বৃষ্টিতে উন্মাতাল আমের মুকুলের ঘ্রাণ। তোমার টিনের চালে ঝমঝম শব্দ আর ঘরের ভেতরে অশ্রুকাজল অন্ধকার। কিন্তু কাছে এলেই আর সবকিছু ছাপিয়ে তোমার ব্যক্তির বিকাশবিদ্বেষী ব্যক্তিত্ববিনাশী ব্যক্তিস্বাধীনতাগ্রাসী ব্যক্তিবিরোধী সমাজ কেন এত চোখে পড়ে, এত গায়ে ফোটে? তুমি কবে মানুষের প্রতি মানবিক হবে? তুমি কবে ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি ভাবতে শিখবে? আচ্ছা লুনা, লোহার টুকরো বুকে বেঁধে বঙ্গোপসাগরের গহিন থেকে সূর্য সেন আর তারকেশ্বর দস্তিদার কেমন করে এই বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছেন? সব দাঁত ভাঙা সব নখ উপড়ানো সারা জীবন ব্রহ্মচর্য পালন করা সূর্য সেন তাঁর যে সোনালি স্বপ্নের চিকচিকে ডিমটা শেষ চিঠিতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটার দশা দেখে তাঁর মন কেমন করে? কোথায় তাঁর কনডেমড সেলে বসে বসে দেখা নবারুণ? এই বাংলাদেশকে, এই ভারতবর্ষকে দেখে সূর্য সেন নিদন্ত বিকৃত মুখে রুষ্ট হূদয় ঢাকতে ঢাকতে তারকেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বলেন, লে হালুয়া (খাস চট্টগ্রামের ভাষায়)?
৮. লুনা রে, আজকে আমি আর কুশান স্ট্রবেরি খেতে গিয়ে স্ট্রবেরি তুললাম, উজ্জ্বল লাল রশ্মির মতন পাকা ফল, শুঁয়াভরা ধারালো পাতা। আলগুলোতে খড় আর ধুলিরঙা মাটি। খেতের সামনে এসে গন্ধে পাগল হয়ে গেলাম। প্রায় এক ঘণ্টা ফল তোলার পরে আমার লেননের ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস ফরেভার’ মনে পড়ল। প্রথম যা মনে পড়েছে, সেটা যতীন্দ্র বাবুর ‘অন্ধ বধূ’র লাইন, ‘তাই তো বলি বসে দোরের পাশে/রাত্তিরে কাল মধুমদির বাসে/আকাশপাতাল কতই মনে হয়’, সত্যি এ মধুমদির বাস—আখখেতের ওপরের বাতাস যেমন চিনির গন্ধে—সর্ষেখেতের ওপরের বাতাস যেমন মধুর গন্ধে মাদক হয়ে থাকে, সে রকম আশ্চর্য পুষ্ট ফলের গন্ধে উপচে পড়ছে খেতের বাতাস। যেন নাক ঘষেছি স্তনের পাশে। সেই রঙিন কাচের মতন লজেন্সগন্ধী শরীরের সঙ্গে। একরকমের প্রসন্নতায়—বীজসহ ফেটে পড়ার মতন অসহ্য সুখে ভরে উঠতে থাকে আমার মন।
৯. ড্যানডেলায়নের বুড়ির চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে কুশান বলে, ‘আই উইশ।’ আমিও বলি, ‘আই উইশ...’ ওর ওপর অনেক রেগে অনেক ফেরি করেছি ওকে—‘ছেলে রাখবেন ছেলে’...আর বলেছি, ‘রেলস্টেশনে রেখে আসব!’ ঠিক যা আমার মা বলত। সে ভ্যাক করে কেঁদে ফেলত, মান-অপমানের তিক্ত কান্না। কিন্তু এখন সে বন্ধু। এখন সে আমার মিথজীবী। এখন সে ক্লোরোফিল। তার সঙ্গে কার্টুন দেখতে দেখতে শিখি ‘সিরানো’ নয় ‘সোয়ান লেক’-এর গল্প। একবার ভাবি ‘মারি সেলেস্ট’ জাহাজের গল্প বলব তাকে, আটলান্টিকে ভাসন্ত শূন্য জাহাজ, চলেছে জিব্রাল্টারের দিকে, ছয় মাসের খাদ্য মজুত, পিপে ভরা পানীয়। কিন্তু আশ্চর্য কারণে জাহাজখানা শূন্য। মনে মনে কান পাতি, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হচ্ছে জাহাজের কাঠে নয় পালে, নির্জনতার শব্দ। ভাবি, আঙুল তুলে দেখিয়ে বলব, ওই জাহাজটা আমি আর লুনা। আসা-যাওয়ার চিহ্ন আছে শুধু। কোথায় গেল লোকগুলো, তা কেউ জানে না। কেউ বলে ভূত। কেউ বলে দানো। আড়াই শ বছর ধরে ভেবে কেউ কূল পায় না। তারপর ভাবি স্নেহ-মায়া-করুণা-সহিষ্ণুতা-ক্ষমা চাষ করতে পারা যায় এমন কী গল্প আমি জানি,
যেটা কুশানকে শোনানো যায়? ডারউইনের পোকার নমুনা মুখে পুরে রাখার বিশ্রী গল্পটা ছাড়া আর কোনো গল্পই এই মুহূর্তে মনে আসছে না। আমার দুই বিড়াল কাশ্মীর আর সাটিন মিলে জানালা দিয়ে ঢুকে যাওয়া আলোর পোকা মারার চেষ্টা করছে—এই পর্ব শেষ হলে যাবে বেসিনের কল থেকে পানি খাওয়া মকশো করতে (লুনা তুই কই?), কাল আরেকটা দিন— জেলখানায় কাজ করতে ঢুকব। উইং থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য আসা কোনো কয়েদি উদ্ভ্রান্ত মুখে এসে জিজ্ঞেস করবে, ‘মিস, ও মিস, তোমার কাছে সাদা-কালো কাগজ আছে? জোড়া দিয়ে দিয়ে দাবার ছক বানাব। জেলে বোরিং লাগে গো মিস!’ ও যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে ১০০ বছর আগে আরও এক কয়েদি দাঁড়াত, যার কাজ ছিল নিষ্ফল সিসিফিয়ান টাস্ক, সারা দিন ঢেঁকি ভানবার মতন পা তোলা আর নামানো, অর্থনীতিতে যা কিছু যোগ দেয় না, বিয়োগ করে না; কথা বলা মানা ছিল তাদের একে অন্যের সঙ্গে, মৌনব্রত ভাঙলেই বেত। তখন এই জেলখানায় সবজিখেত আর পাতকুয়া ছিল, ফুলের বাগান ছিল না, ময়ূর ছিল না।

No comments

Powered by Blogger.