'কেউ কথা রাখেনি' by কর্নেল এস এম শওকত আলী

গত ১৯ নভেম্বর ২০১২ বরিশাল বঙ্গবন্ধু পার্ক ময়দানে ১৮ দলের এক বিশাল জনসভায় ভাষণদানকালে বিরোধীদলীয় নেত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন, দুই-দুবার নির্বাচিত বাংলাদেশের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে আকুল আবেদন করে বলেছেন, 'আমাকে সমর্থন করুন, আরেকবার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ দিন।
আমি আগামীতে সন্ত্রাস-দুর্নীতি বন্ধ করে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দেব।' বেগম জিয়ার নেতৃত্বে তাঁর দল বা জোট বৈধভাবে দুবার এ দেশকে শাসন করেছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫; অতঃপর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার অর্থাৎ ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের আবরণে, যার প্রধান শরিক দল ছিল বহু আলোচিত ও সমালোচিত জামায়াতে ইসলামী। এ শাসনকালের কথা বাংলাদেশের সচেতন-বুদ্ধিসম্পন্ন, বিবেকবান মানুষ হৃদয়পটে অতিযত্নসহকারে ধারণ করে রেখেছেন। বিস্মৃতি হননি বিন্দুমাত্র। শতপ্রচেষ্টায় মানুষের স্মৃতিকোঠায় দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া সব কিছু ধরে রাখা সম্ভব নয়; কিন্তু আবার এমন কিছু ঘটনা থাকে, যা শতচেষ্টায় স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা যায় না। তাই ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত, বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসন আমল এ দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে কিভাবে বিস্মৃত হবে! গ্রামবাংলায় একটা কথার প্রচলন আছে 'যে বিড়ালটি ইঁদুর মারে তার গোঁফ দেখলেই টের পাওয়া যায়।' সন্ত্রাস, দুর্নীতি বন্ধ করে বেগম জিয়া বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিতে চেয়েছেন। আপনি দুই-দুবার ক্ষমতায় থাকার ১০ বছরকালে বাংলাদেশের কোথায় কতটা চেহারা পাল্টে দিয়েছেন, একটু অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে দেখবেন কি!
আপনার শাসনামলেই প্রথম এ দেশে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে পাকা আসন করে নিয়েছিল। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদ-মন্দির, বিচারালয়-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজপথ-জনপথ ও বিরোধীদলীয় নেত-কর্মীসহ সাধারণ জনগণ। রক্তবন্যা বয়েছে সর্বত্র। আর দুর্নীতির কথা বলছেন! সে তো রাজপ্রাসাদ থেকে জীর্ণকুটির পর্যন্ত স্ববৈভবে বিস্তৃত ছিল। তাই বুঝি আপনার বক্তব্যে উঠে এসেছে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বন্ধের কথা। বোধ করি, বিশাল জনতার সামনে দাঁড়িয়ে আপনার শাসনামলের দুর্বলতার প্রধান দুটি স্তম্ভ অবচেতন মনেই আপনার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। সত্যিই কি আপনি বা আপনার দল কিংবা জোট আন্তরিকভাবে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমন করতে বদ্ধপরিকর? আপনাদের গৌরবময় অতীত বিশ্লেষণ করলে তো এমন মনে হয় না। আপনাদের জোটের রূপরেখার মাঝেই তো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ লুকিয়ে আছে। যাদের ব্যতিরেকে আপনাদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন অবান্তর। পারবেন কি তাদের উপক্ষো করতে! সত্যি বলতে কি, ক্ষমতার স্বাদ পেলে আপনারা এমন এক চক্রে আবদ্ধ হয়ে যান, তখন কবে-কোথায়-কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটা মনে করে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিন্দুমাত্র আবশ্যকতা আছে বলে মনে করেন না। তাই আপনাদের প্রতিশ্রুতিতে মানুষ আর কতকাল আস্থা রাখবে, বিশ্বাস করবে, শ্রদ্ধা দেখাবে!
মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, আপনার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিন্দুমাত্র কোনো কারণ নেই। জনগণের কাছে শুধু শুধু এত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আপনি খামোখা দেশের চেহারা পাল্টে দিতে চাচ্ছেন! দেশের মানুষ তো মোটা চালের ভাত খেয়ে, মোটা কাপড়ের পোশাক পরে মোটামুটি ভালোই আছে। অন্নহীন-বস্ত্রহীন কিংবা কোথাও দুর্ভিক্ষ, মঙ্গার পদধ্বনি শোনা যায় না। তার পরও আপনার পরিবর্তনের রূপরেখাটা কি সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরবেন। যাতে এ দেশের মানুষ আবার আশায় বুক বাঁধতে পারে। আপনার বিগত দিনের শাসনামল কিন্তু তাদের কাছে মোটেও সুখকর নয়। তারা সন্ত্রাসবাদের ভয়ে শঙ্কিত হয়। দুর্নীতির কালোথাবা সমাজের প্রতিটি রন্ধে শিকড় গেড়ে বসার ভয়ে কুকড়ে ওঠে। দুঃশাসনের অপঘাতে জর্জরিত হওয়ায় আশঙ্কায় বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তবে হ্যাঁ, একশ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষ যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, তাদের কথা ভিন্ন। আপনার শাসনামলে মুখে মুখে উন্নয়নের জোয়ার প্রতিটি বেলাভূমিসহ অভয়ারণ্যে আছড়ে পড়লেও বাস্তবে তার উপস্থিতি একেবারেই অধরা। আপনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শিক্ষা খাত, বিদ্যুৎ খাত, যোগাযোগব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন, সুশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কী কী অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল, সে বিষয়ে এ দেশের মানুষ আত্মভোলা হলেও একেবারে ভুলে যায়নি।
আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, কোনো অবাস্তব প্রতিশ্রুতি কিংবা আপনার বিগত শাসনামলের স্মৃতিচারণার কোনো কিছুরই প্রয়োজন হবে না। আপনারা ভাগ্যবান। সোনার চামুচ মুখে দিয়ে এ ধরিত্রীতে আবির্ভূত হয়েছেন। রাজনীতির স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ভাওয়েল, কনসোনেন্ট জ্ঞান ব্যতীত ইতিহাসে বাংলাদেশের রাজনীতির রূঢ় সন্ধিক্ষণে এর রঙ্গমঞ্চে আকাশের ধ্রুবতারার মতো আপনাদের আবির্ভাব। অঞ্জলি পূর্ণ করে রাজনীতিতে প্রায় সব উপাদান, উপাত্ত দিয়ে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আপনাদের পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সরাসরি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান করে। আর এটা এতই সহজলব্ধ হয়েছে যে এলেন, দেখলেন, জয় করলেন আর দুঃখী জনগণকে কিছু না দিয়েই চলে গেলেন! আবার অতিঅস্থিরতার সঙ্গে সিংহাসনে আরোহণের প্রহর গুনছেন। আর হ্যাঁ, রাজনীতির পালাবদলের যে মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা সেই ১৯৯১ সাল থেকে অদ্যাবধি চলে আসছে, সে বিবেচনায় তো আপনার ভাগ্যাকাশে উজ্জ্বল সম্ভাবনার আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কাজেই সন্ত্রাস-দুর্নীতি, অপশাসন অবসানের মিছে প্রতিশ্রুতির কোনো প্রয়োজন আছে কি? এ দেশের ভোটাররা নিরুপায়। তারা কোথায় যাবে? আপনাদের ত্যাগ করে অন্য কোথাও, অন্য কাউকে ভোট দেবে- সে আবহ কি বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে; কিংবা আদৌ কোনো দিন হবে? তেমনটি মনে হয় না। তাই তো তাদের ভোটদান সীমাবদ্ধ থাকে রাম কিংবা শ্যাম, যদু কিংবা মধু, দবির কিংবা খবিরের মধ্যে।
আপনাদের ভাগ্য কত সুপ্রসন্ন, কোনো কৃতকর্মের জন্য যাদের মহামূল্যবান ভোটের বদৌলতে সিংহাসনে আরোহণের জিয়নকাঠি লাভ করেন, তাদের কাছে ব্যর্থতার কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। তাদের প্রতি আপনাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আপনারা যেভাবে দেশ পরিচালনা করেন না কেন, আপনাদের সুশাসন-অপশাসন তারা অবনত শিরেই গ্রহণ করে কোনো প্রশ্ন ব্যতিরেকে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, আবেগ-অনুভূতি আপনাতেই প্রথিত থাকে। তাদের খোঁজখবর নেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আপনাদের নেই। শুধু ভোটের সময় ভুলিয়ে-ভালিয়ে ভোটগুলো আপনাদের প্রতীকে নিশ্চিত করতে পারলেই হলো। এরপর তো আমজনতার প্রতি আপনাদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। 'হিজ হিজ, হুজ হুজ'- 'যার যার, তার তার।' আল্লার মাল আল্লায় রক্ষা করবে।
মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, আপনার নিশ্চয়ই চীন দেশের ইতিহাসের সেই অধ্যায়ের কথা মনে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজরা চীনে ব্যবসা ও শাসন করতে এসে তাদের যুগের পর যুগ আফিম খাইয়ে ঘুমিয়ে রেখেছিল; চীনারা যাতে ইংরেজদের অপকৌশল ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে না পারে। বাংলাদেশের জনগণ বড় আত্মভোলা; অতি সহজেই সব কিছু তাদের স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের জনগণ অতি মহানুভব। তারা অতীত যেমন অতিদ্রুত ভুলে যায়, তেমনি দ্রুত ক্ষমা করে দেয়। আর সেখানেই আপনাদের পরিত্রাণ। আপনাদের অতীতের সব অপশাসন-দুঃশাসনের মহাকাব্য কারো স্মৃতিপটে দগদগে জীবন্ত থাকে না। প্রয়োজন হয় না এ দেশের মানুষকে আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার। তারা দৈনন্দিন জীবনে এত বেশি সমস্যায় জর্জড়িত যে এমনিতেই তাদের চক্ষু বন্ধ হয়ে থাকে। তারা বর্তমান নিয়েই খাবি খায়। স্মৃতিরেখা অতীত পর্যন্ত বিস্তৃত করার সময় কোথায়, সময় নষ্ট করে? তাই তো আপনাদের আমলের এত ঘটনাবহুল অঘটনের পরও নির্বিঘ্নে আপনারা অতীতের সব অপকর্মের জন্য জনতার কাছে কোনো ক্ষমা বা অনুশোচনা ব্যক্ত না করেই ছুটে যান ভোটের আশায়। ক্ষমতার এই সোনার হরিণ বা দিলি্লকা লাড্ডু এতই মোহনীয় যে একবার এর স্বাদ পেলে কেউ তা থেকে নিজেকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত করতে পারে না। পিছু পিছু ছুটতে থাকে এই আশায় 'তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।' তা না হলে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো একজন অশীতিপর বৃদ্ধ, যিনি দীর্ঘ ৯ বছর এককভাবে দৃঢ়হস্তে এ দেশের শাসনভার পরিচালনার পরও রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে স্ববৈভবে যত্রতত্র উঁকি মারেন, যদি আবার ক্ষমতায় যাওয়া যায়। ৯ বছরের এত অপকর্মের পরও বিচরণ করেন রাজনীতির কূটিল গলির পথ ধরে কোনো ফাঁকফোকরে যদি আবার রাষ্ট্রপতির তক্মাটা গায়ে লাগানো যায়। সেই ১৯৯০-এর পর থেকে অনেক মামলা-মোকদ্দমা মোকাবিলা করে জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে মনের অতিকোমল স্থানে পুনরায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার তীব্র বাসনা ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন সম্মুখপানে। আমি তো তার একার কোনো দোষ দেখি না। যদি অন্য সবাই দেশবাসীর কণামাত্র কল্যাণ না করে পুনঃ পুনঃ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে, তবে তাঁর তো স্বাদ-আহ্লাদ থাকতে পারে পুনরায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার! 'সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!'
যদি সব কিছু ঠিক থাকে তবে ২০১৪ সালের প্রথমদিকে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হবে। সেই অর্থে সময় অত্যাসন্ন। এখনই জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের সময়। এই প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারকে যত আকর্ষণীয় করা যায় সেটা করে যান। এর জন্য কোনো প্রকল্পের প্রয়োজন হবে না। লাগবে না কোনো আর্থিক বরাদ্দ। ভবিষ্যতে কাউকে কোনো কৈফিয়তও দিতে হবে না। আপনি যদি এ দেশের চেহারা পাল্টে দিয়ে সুইজারল্যান্ড বানাতে চান, সহজ-সরল জনগণ বিশ্বাস করবে আস্থার সঙ্গে। কারণ আপনি তো দেশনেত্রী। আপনার অতীতের কোনো ব্যর্থতার কথা তারা মনে রাখবে না। তারা অতীতকে রোমন্থন করতে চায় না। তারা বর্তমানকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেদিক দিয়ে আপনি অতি নিরাপদ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশের আমজনতা ধাতস্থ হয়ে গেছে আপনাদের মতো বড় নেতাদের অঙ্গীকার ভাঙার মহড়া দেখে দেখে। এ দেশের মানুষের হৃদয়ে জেগে আছে সদ্যপ্রয়াত বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ সুনীল গাঙ্গুলীর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনটি 'কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বৎসর কাটল কেউ কথা রাখেনি।'
লেখক : একজন মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.